জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ৫০টি জেলায় ছাত্র–জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় ৪১টি জেলার ৪৩৮টি স্থানে। গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে এই তথ্য উল্লেখ করেন। তিনি এই মামলার ৫৪তম ও সর্বশেষ সাক্ষী। মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) তাঁর জবানবন্দি রেকর্ড করা শেষ হয়, যা শুরু হয়েছিল গত রোববার।
জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর বলেন, আন্দোলনকারীরা ছিলেন নিরীহ এবং নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা। তৎকালীন সরকার এনটিএমসির (টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) মতো প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে মুঠোফোনের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের শনাক্ত করে হত্যা ও জখমের পাশাপাশি অন্যায়ভাবে আটক–গ্রেপ্তার করেছিল। এমনকি আন্দোলনকারীদের শনাক্ত করতে ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল। আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণকারীরা ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং তৎকালীন সরকারদলীয় সশস্ত্র ক্যাডার।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা ছিল ব্যাপক মাত্রায় এবং পদ্ধতিগতভাবে সাধারণ মানুষের ওপর লক্ষ্যভিত্তিক নিপীড়ন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান এবং পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি।
শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা এই মামলার বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১–এ। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
ক্ষমতায় টিকে থাকতে খুন-গুম ও নির্যাতন
সাক্ষীর জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর বলেন, ‘আমি তদন্তকালে পেয়েছি যে ২০২৪ সালের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার যত গুম, খুন, জখম, অপহরণ ও নির্যাতন করেছে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকা। এ ছাড়া গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিরোধী দল, মত ও প্রতিপক্ষের ওপর হত্যা, জঙ্গি নাটক, জোরপূর্বক অপহরণ, গুমসহ পাতানো নির্বাচনের মতো সব কিছুর মূলে ছিল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার বাসনা। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসেছে, তখন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য যত রকমের ব্যবস্থা আছে তার সবই গ্রহণ করেছে। এর ফলশ্রুতিতে ২০২৪ সালের আন্দোলনে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেছে।’
এদিকে এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার জবানবন্দির অংশবিশেষ ও জব্দ করা ভিডিও বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সেই জুলাই আন্দোলনে নৃশংসতা নিয়ে বিবিসি ও আল জাজিরায় প্রচারিত ভিডিওচিত্রও জব্দ তালিকার অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত হয়। ঐতিহাসিক এই মামলায় এর আগে সাক্ষ্য দিয়েছেন গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রতীক শহীদ আবু সাঈদের পিতাসহ স্বজনহারা অনেক পরিবার। এ ছাড়া স্টার উইটনেস হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান।