মাত্র কয়েক মাসেই এলোমেলো হয়ে গেছে বরিশাল শিল্পকলা একাডেমি। জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগের দোসর অশিত বরণ দাসগুপ্ত সাংস্কৃতিক এই প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর থেকে শিল্পীসমাজে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। গুণী শিল্পীদের অবজ্ঞা করাসহ স্বেচ্ছাচারিতা এবং বহুমুখী অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে কালচারাল অফিসার অশিত বরণ শিল্পকলার অতীত ঐতিহ্য ম্লান করে চলছেন।
এ নিয়ে শিল্পীসমাজে তুমুল ক্ষোভ এবং হতাশা বিরাজ করলেও চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস দেখাচ্ছেন না।
অভিযোগ আছে, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসর অশিত বরণ পূর্বের কর্মস্থল সিলেট শিল্পকলায় কর্মরত থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে নারীকে শ্লীলতাহানি করাসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেই সময় সেখানকার শিল্পীসমাজ তার অপসারণ চেয়ে একাধিকবার আন্দোলনও করেন। কিন্তু তৎকালীন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর কাছের মানুষ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এই তথ্য নিশ্চিত করে সিলেট শিল্পকলার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিতর্কিত অশিত বরণের বিরুদ্ধে তৎকালে একাধিকবার সিলেটের শিল্পীসমাজ সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করে। কিন্তু প্রভাবশালী এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, বরং তাকে একাধিকবার শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়, যা নিয়ে তুমুল বিতর্ক রয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পতন হলে সিলেটের কালচারাল অফিসার অশিত বরণের চেয়ার নড়বড়ে হয়ে যায়। পরে বিতর্কিত এই কর্মকর্তাকে বরিশালে বদলি করা হয়।
এ নিয়ে কীর্তনখোলার তীরের জনপদ কবি জীবনানন্দের শহরের শিল্পীসমাজের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার যোগদান ঠেকানো সম্ভব হয়নি। তিনি চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিতর্কিত অশিত বরণ যোগদানের পরপরই তিনি সাব্বির নেওয়াজ এবং অপূর্ব গোমস্তা রিকসহ বেশ কয়েকজন তথাকথিত পরামর্শকের বুদ্ধিতে বরিশাল শিল্পকলা থেকে গুণী শিল্পীদের বিতাড়িত করতে তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিনা বেতনে এক বছর যারা শিল্পচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের তাড়িয়ে নিজের পছন্দসই ব্যক্তিবিশেষকে নিয়োগ দেওয়ার পাঁয়তারা করছেন।
শিল্পীদের একটি সূত্র জানিয়েছে, এর আগে এক নোটিসের মাধ্যমে গত ১ জুলাই থেকে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেন অশিত বরণ। তা নিয়ে অভিভাবকেরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন, যা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ পেলে তাকে ঘিরে জোরালো বিতর্ক দেখা দেয়। তখন চাপের মুখে তিনি তড়িঘড়ি করে পূর্বের প্রশিক্ষক দিয়েই ৮ জুলাই থেকে নতুন করে আবার প্রশিক্ষণ বিভাগ চালু করেন।
বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে, বরিশাল শিল্পকলায় চেপে বসা এই বিতর্কিত কর্মকর্তা অশিত বরণ বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) সাব্বির নেওয়াজের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছেন। এবং এই রাজনীতিকের পরামর্শেই মৈত্রী ঘরামী, সোহেল, রাণী গোমেজ, রিমি সাব্বির এবং রফিকুল ইসলামের মতো গুণী প্রশিক্ষকদের শিল্পকলাছাড়া করতে চাইছেন। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, তিনি নতুনভাবে ৮টি পদে যাদের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে চাইছেন, তাদের কাছেও বিভিন্ন মাধ্যমে ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।
সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র শিল্পকলাকে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতায় রূপ দেওয়ায় কালচারাল অফিসার অশিত বরণ এবার প্রশাসনের তদন্তের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। মুহম্মদ ইমন খন্দকার হৃদয় নামের জনৈক সমাজকর্মীর অভিযোগের প্রেক্ষাপটে কালচারাল অফিসার অশিত বরণের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি ও প্রশাসনিক অনিয়মসংক্রান্ত বিষয়গুলোর তদন্ত শুরু করেছে বরিশাল জেলা প্রশাসন।
সূত্রে জানা গেছে, ৬ আগস্ট থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি ও শিক্ষা) উপমা ফারিসার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম কালচারাল অফিসারের দুর্নীতি খতিয়ে দেখছেন। এ নিয়ে এরই মধ্যে এক দফা শুনানিও হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, অশিত বরণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, এর যদি আংশিক প্রমাণ মেলেও তাতেও তার ভবিষ্যৎ বিষাদময় হয়ে উঠতে পারে। কারণ এই কর্মকর্তার অতীত ইতিহাস তেমন একটা সুখকর নয়। তিনি পূর্বের কর্মস্থলে বহু অপকর্মে জড়িত থেকেছেন, তার পর্যাপ্ত প্রমাণ বরিশালের শিল্পীসমাজের কাছে রয়েছে এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক মহলেও সেগুলো উপস্থাপন করা হচ্ছে।
এ ধরনের একজন বিতর্কিত কর্মকর্তা বিখ্যাত কবি কুসুমকুমারি দাস, আহসান হাবিব এবং সুফিয়া কামালের জন্মভূমি বরিশালের কবিসহ শিল্পীসমাজকে অবমূল্যায়ন করার বিষয়টিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। একাধিক সংস্কৃতিক কর্মীর দাবি, অশিত বরণকে শাস্তিমূলক বরিশাল শিল্পকলা থেকে অপসারণ করাসহ তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো সঠিকভাবে তদন্ত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
এই বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি ও শিক্ষা) উপমা ফারিসার ভাষ্য হচ্ছে, অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে। অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত কালচারাল অফিসের বয়ান গ্রহণ করা হয়েছে। আরও কিছু তদন্তকাজ বাকি রয়েছে, সেগুলো শেষ হলে রিপোর্ট জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :