- সন্দেহের তির স্থানীয় দালাল ও এক ট্রাভেল এজেন্সির দিকে
- এখনো অস্বাভাবিক কিছু পায়নি পুলিশ
এখনো রহস্যে ঘেরা রাজধানীর মৌচাকে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের পার্কিংয়ে থাকা একটি গাড়ি থেকে উদ্ধার দুজনের মরদেহের ঘটনা। স্বজনদের দাবি, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। তারা জানান, জাকিরকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর কথা বলে ২৫ লাখ টাকা নিয়েছিল এক দালাল। কিন্তু তাকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে অবৈধ পথে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। পরিবার আরও টাকাপয়সা দিয়ে তাকে ফেরত আনতে সক্ষম হয়। জাকির সেই টাকা আর তুলতে পারেননি। গত রোববার টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরদিন সোমবার তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তবে দুজনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় এখন পর্যন্ত অস্বাভাবিক কিছু পায়নি পুলিশ। হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে বেজমেন্টে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেখা যায়নি। ঘটনাস্থলেও কাউকে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গত সোমবার হাসপাতালের পার্কিংয়ে থাকা একটি গাড়ি থেকে জাকির ও মিজানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জাকির হোসেন ও মিজানুর রহমান দুজন সম্পর্কে বন্ধু। তাদের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলায়। বিকৃত লাশ দুটি ৩০ ঘণ্টা ধরে গাড়িতে, একজনের মুখ ছিল থ্যাঁতলানো। জাকির ভাড়ায় গাড়ি চালাতেন। গত শনিবার রাতে বিমানবন্দরে ভাড়া নিয়ে আসেন তিনি। পরদিন রোববার ভোরে এক রোগীকে নিতে ওই প্রাইভেট কারে হাসপাতালে আসেন তারা। গাড়িটি পার্কিংয়ে ছিল। গত সোমবার দুপুরে জাকির ও মিজানের লাশ উদ্ধার করা হয় সেই গাড়ি থেকে। পরে মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়।
অন্যদিকে জাকিরের বাবা মো. আবু তাহের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ছেলের কারও সঙ্গে কোনো ঝগড়াঝাটি নাই। কোনো রাজনীতির সঙ্গে সে জড়িত না। কারা তাকে মেরেছে, তা-ও জানি না। তবে দুই বছর আগে আমেরিকায় যাওয়ার জন্য এলাকার এক দালালকে টাকা দিয়েছিলাম। সেই দালাল তাদের নিয়ে এসেছিল ঢাকার পল্টনে এক ট্রাভেল এজেন্সির ফজলু নামে এক ব্যক্তির কাছে। সব মিলিয়ে তখন প্রায় ২৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। এরপর জাকিরকে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে অবৈধ পথে আমেরিকায় পাঠানোর কথা ছিল। তবে তখন সেটি পারেনি।
এরপর আরও কিছু টাকা দিয়ে জাকিরকে আমরাই দেশে ফেরত আনি। এরপর থেকে ফজলুর কাছে সেই টাকা ফেরত চাইতে গেলে সে কিছুদিন পর টাকা ফেরত দেবে বলে জানায়। এরপর বহুবার তার পেছনে ঘুরেও টাকা ফেরত পাচ্ছিলাম না। এই টাকা চাওয়ার কারণে তারা আমার ছেলেকে একবার মারধরও করেছিল। সবশেষ কিছুদিন আগে এলাকায় দালালের সঙ্গে কথা হয় এবং সে স্ট্যাম্পে সই করে যে চলতি মাসের ১০ তারিখে সেই টাকা ঢাকায় এজেন্সিতে এসে ফেরত দেবে। কিন্তু ওই ১০ তারিখেই জাকিরকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ ঘটনা তারাই ঘটিয়েছে বলে আমাদের ধারণা।’
এদিকে মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনে রমনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আওলাদ হোসেন বলেছেন, জাকির ও মিজানের শরীরের বিভিন্ন জায়গা ফোলা এবং ফোসকা পড়া। এ ছাড়া তাদের মুখ লালচে ফোলা ও রক্তমাখা ছিল। তবে প্রাথমিকভাবে তাদের মৃত্যুর কারণ উল্লেখ ছিল না প্রতিবেদনে।
গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে মিজানের ভাগিনা মো. রিয়াদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার মামা আগে গ্রামে বালুর ব্যবসা করতেন। তবে সেই ব্যবসা বাদ দিয়ে তিনি মাছের খামার করেছিলেন। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। জাকির তার বন্ধু। জাকির প্রাইভেট কার চালাতেন। প্রায়ই মামাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। মামাকে গাড়ি চালানো শেখাতেন। গত শনিবার রাতে তারা দুজন, গাড়ির মালিক ও মালিকের সম্বন্ধী গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। ওই দিন রাতে মালিকের সম্বন্ধীর দেশের বাইরে যাওয়ার ফ্লাইট ছিল।
বিমানবন্দর থেকে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেলে আসেন। একজন রোগীকে নিয়ে পরদিন গ্রামে ফেরার কথা ছিল তাদের। এরপর কী হয়েছে, আমরা জানি না। তবে তাদের মেরে ফেলা হয়েছে, এটা বুঝতে পারছি।’
এ বিষয়ে রমনা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, ‘আমরা সিসি ফুটেজের পুরোটা দেখার চেষ্টা করেছি। সেখানে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে কি না, কেউ গেল কি না দেখেছি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কেমিক্যাল এক্সামিনেশন হবে, সিআইডির তদন্ত সব বিষয় একসঙ্গে করলে আমরা ঘটনাটা বুঝতে পারব। এর বাইরে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন বিষয় থাকতে পারে। আমরা তাদের বিষয়গুলোও নেব এবং তদন্ত করব।’
সিসি ক্যামেরা ফুটেজে ঘটনাস্থলে কাউকে দেখা গেছে কি না, জানতে চাইলে ডিসি মাসুদ আলম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ওইভাবে আমরা কাউকে পাইনি। তবে হাসপাতালের দুজন কর্মচারীকে আমরা পেয়েছি, হাসপাতালে কোনো স্মোকিং এরিয়া না থাকায় তারা নিচে গিয়ে স্মোকিং করে এসেছেন। তাদের দুজনের সঙ্গেই আমরা কথা বলেছি। সেখানে তাদের সঙ্গে জড়িত কোনো কিছু মনে হয়নি। অস্বাভাবিক কোনো কিছু এখন পর্যন্ত মনে হয়নি।’
ডিসি মাসুদ আলম বলেন, ‘ঘটনা যেহেতু ঘটেছে, কী কারণে ঘটেছে, কেন ঘটেছে, তার উত্তর এখনই দেওয়া সম্ভব নয়। ময়নাতদন্তের রিপোর্টসহ অন্য রিপোর্ট পাওয়ার পর জানা যাবে। আমরা সিসি ফুটেজ আরও পর্যবেক্ষণ করব।’
এ ঘটনায় মামলা হবে বলেও জানান মাসুদ আলম। তবে প্রাথমিকভাবে পুলিশ অপমৃত্যুর মামলা নেবে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ও অন্যান্য বিষয় আরও পর্যবেক্ষণ করে হত্যার কোনো আলামত পাওয়া গেলে তাা হত্যা মামলা হিসেবে নেওয়া হবে।