বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) সরবরাহ করা পানি থেকে প্রায় ২১৮ বিলিয়ন টাকার বাৎসরিক খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয়। এটি বন্ধের ব্যবস্থা করলে দেশে খাদ্যসংকটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে।
বিএনপির রাজশাহী মহানগর কমিটির সাবেক সহসভাপতি মো. সোহরাব হোসেন শেখ বলেন, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর কৃষি মন্ত্রণালয় সব ধরনের প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ রেখেছে উত্তরাঞ্চলের জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিকে। প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যর্থ বানাতে এ চেষ্টা হতে পারে। এরই মধ্যে শুনছি, এটি অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের আওতায় একীভূত করারও চেষ্টা চলছে। জনগণের প্রতিষ্ঠানে জনপ্রতিনিধি ছাড়াই (পরিচালনা পর্ষদ) বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএডিসিতে) একীভূত করার আগ পর্যন্ত চেয়ারম্যান পদটিও শূন্য রাখা হবে বলে শুনছি। উত্তরাঞ্চলে বিএডিসির অর্জন ও বিএমডিএর অর্জন দেখলে বোঝা যাবে, আসলে কী ঘটতে পারে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) অপসারণের বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। একই বিষয়ের ওপর করা কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির শুনানিতে বিএমডিএকে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়টি সাক্ষীসহ সবার কাছ থেকে তদন্ত কমিটি লিখিয়ে নিয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছেন। তদন্তে ঘটনার কারণ উদঘাটন না হলেও সাক্ষীদের কাছ থেকে কয়েকটি সুপারিশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে।
বিএনপির রাজশাহী মহানগর কমিটির সাবেক এই সহসভাপতি বলেন, ১৯৮৫ সালে বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প (বিআইএডিপি) থেকে জনবল নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চালু করা হয়। ১৯৯২ সালে নতুন নামকরণ করা হয় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ পাস হয় সংসদে। এসবের মধ্য দিয়ে দেশের খাদ্য উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা রেখে চলেছে বিএমডিএ। তবে প্রতিষ্ঠানটির কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি বা অপরাধ করলে তার শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। ব্যক্তির অপরাধের দায়ে প্রতিষ্ঠান বা দেশকে শাস্তির আওতায় আনা রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধের সমান। বিএমডিএ বন্ধের ব্যবস্থা করলে দেশে খাদ্যসংকট নয় শুধু, রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, ১৯৮৫ সালে উত্তরাঞ্চল মরুময় হয়েছিল। তখন বছরে একটি ফসল হতো বৃষ্টি ঠিকমতো হলে। সেটাও আবার বিঘাপ্রতি ৪-৫ মণ। বৃষ্টি ঠিকমতো না হলে কৃষকের সব পরিশ্রম বৃথা করে একমুঠো ধানও হতো না। এখন বিঘায় ২৫-৩০ মণও হয়। তাও বছরে তিনবার তথা একই জমিতে তিনটি ফসল হয়। একই জমিকে তিন ফসলি জমি পরিণত করাতে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে এই বিএমডিএ। বহুদিন থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে জনবল নিয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে। যেন বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে আলো-বাতাস চাওয়ার মতো মনে হয়। তবে বিএমডিএ দেশে খাদ্য উৎপাদনের নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে।
বিএমডিএর তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সাড়ে ৩ হেক্টর লাখ জমি আমন, ৩ লাখ ২০ হাজার হেক্টরে বোরো, ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ ধান উৎপাদন হয়েছে। এতে ঠিকমতো পানি সরবরাহ করেছে বিএমডিএ। এ ছাড়া সরিষা ১২ হেক্টর, গম ৮৭ হাজার ২৮৩ হেক্টর, আলু ৭৫ হেক্টর ও ৭৮ হাজার মৌসুমি ফসলের জমিতে পানি সেচ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. ফরহাদ খন্দকার ও রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোছা. উম্মে ছালমার দেওয়া তথ্যে জানা যায়, গত অর্থবছরে প্রতি হেক্টরে আমন ধান উৎপাদন হয়েছে ৫.৪ টন। প্রতি হেক্টরে আউশ ধান উৎপাদন হয়েছে ৪.৮ টন। প্রতি হেক্টরে বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে ৭.২ টন। প্রতি হেক্টরে গম উৎপাদন হয়েছে ৪.৪ টন, প্রতি হেক্টরে সরিষা উৎপাদন হয়েছে ১.৫ টন ও প্রতি হেক্টরে আলু উৎপাদন হয়েছে ২৬.৭৭ টন।
প্রাপ্ত তথ্য ও সরকারি দাম অনুযায়ী, সাড়ে ৩ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৬ লাখ ৮০ হাজার টন। প্রতি কেজি ৩৩ টাকা দাম ধরে ৫ হাজার ৫৪৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ ধান ৪ লাখ ৫ হাজার টন। ৩৩ টাকা দাম ধরে আউশ ধানের দাম ১ হাজার ৩৩৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ৩ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে ২৩ লাখ ৪ হাজার টন। প্রতি কেজি ৩৬ টাকা দাম ধরে ৮ হাজার ২৯৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ৭৫ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছে ২০ লাখ ৭ হাজার ৭৫০ টাকা। ২২ টাকা কেজি ধরে ৪৪১৭ কোটি ৫ লাখ টাকা। ৭৫ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৫০০ টন। ৩৮ টাকা কেজি দর ধরে উৎপাদন হয়েছে ৪৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ৮৭ হাজার ২৮৩ হেক্টর জমিতে গম উৎপাদন হয়েছে ৪৮ লাখ ৪৪ হাজার ৪৫২ টন, যা ৪৯ টাকা কেজি দরে হয় ১ হাজার ৮৭৭ কোটি ৮২ লাখ ৪ হাজার ৮০০ টাকা। আমন, আউশ, বোরো, আলু, গম ও সরিষা মিলে মোট প্রায় ২১৮ বিলিয়ন টাকার খাদ্য উৎপাদনে সরাসরি সেচ দিয়ে আসছে বিএমডিএ। এ ছাড়া মৌসুমি ফসল রয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার হেক্টর জমিতে। সময় স্বল্পতায় মৌসুমি ফসলের পরিমাণ ও দর নির্ধারণ করা যায়নি।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) মো. তরিকুল আলম বলেন, মাত্র ৭৪৩ জন জনবল দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, বিএমডিএর পানি উত্তোলনে কার্ড ব্যবহার নিয়মটি খুব সুন্দর। তারা দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে অপরিসীম ভূমিকা পালন করছে। সরকারকে জনবল নিয়োগসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা উচিত। কোথাও দুর্নীতি-অনিয়ম থাকলে সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে। বিএডিসি ও বিএমডিএ একীভূত করা সমীচীন হবে না। দুই প্রতিষ্ঠানের অর্জন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেই সিদ্ধান্তে যেতে হবে।
তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলের কৃষিই প্রধান পেশা। এ এলাকার মানুষ রাজশাহীতে এসে কম সময়ে অল্প খরচে সেবা পায়। এতে রাজধানীর ওপর কিছুটা চাপ কমে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন