বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, শৃঙ্খলিত সংবাদপত্র মানে শৃঙ্খলিত সমাজ। মানবিক বাংলাদেশের অভীষ্ট অর্জনে মুক্ত গণমাধ্যম অন্যতম পূর্বশর্ত। তাই সাংবাদিকতাকে বাধাহীন করতে হবে। তিনি বলেন, যে সমাজে মানুষ নিজের মনের কথা নিঃশঙ্কচিত্তে উচ্চারণ করতে পারে না, সেই সমাজে বিবেকের দিশাও হারিয়ে যায়। সমাজের মানবিক মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হয়।
গতকাল শনিবার দুপুরে সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোরের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। যশোর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোরের সভাপতি আকরামুজ্জামানের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ ও তৌহিদ জামানের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা নার্গিস বেগম, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, সহকারী মহাসচিব এহতেশামুল হক শাওন, যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, যশোর জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম রসুল, শান্তনু ইসলাম সুমিত, যশোর প্রেসক্লাবের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন, সাধারণ সম্পাদক এস এম তৌহিদুর রহমান, নুরুল ইসলাম, এম আইউব, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আনিসুজ্জামান ও আবদুর রাজ্জাক রানা বক্তব্য দেন।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, একজন সাংবাদিকের কাজ সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা। সে জন্য গণমাধ্যমকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। এই দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয় সমাজের প্রতিচিত্র। অন্যায়, অনিয়ম, নিগ্রহ, শোষণ-বঞ্চনা এবং অধিকার হরণের বিরুদ্ধে একজন সাংবাদিককে সোচ্চার থাকতে হয় সব সময়। চোখ রাঙানোকে গণ্য না করে নির্ভীক ও নিরলসভাবে কাজ করতে হয়। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার চিত্র প্রত্যক্ষ করতে হয়। মানুষের সমস্যার কথা তুলে ধরার দায়িত্ব পালন করতে হয়। অনেক বাধাবিপত্তির মধ্যে তাদের দিন যায়। ক্ষমতাধরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হয়। অভাব-অনটনের মধ্যে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে হয়।
একজন সাংবাদিকের কাজ সত্যকে খুঁজে বের করা এবং সেই সত্যকে রক্ষা করা।তাই সাংবাদিককে যেমন সাহসী হতে হয়, তেমনি সত্যনিষ্ঠ ও নীতির প্রশ্নে আপসহীন এবং ন্যায়ের প্রশ্নে অবিচল থাকতে হয়।
তিনি বলেন, গণমাধ্যমের নৈতিকতার মূল উদ্দেশ্য হলো সত্য তথ্যের সঠিক পরিবেশনা। একজন সাংবাদিক সবার আগে সত্যের কাছে এবং পরে তার পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন; এর বাইরে কারো কাছেই সাংবাদিকেরা দায়বদ্ধ নন। সততা, নির্ভুলতা ও পক্ষপাতহীনতাÑ সার্বিকভাবে এই তিন হলো সাংবাদিকতার নীতিমালার মূল ভিত্তি; কোনো অবস্থাতেই এর কোনো একটিরও ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। রিপোর্টে উল্লেখ করা প্রতিটি তথ্য শতভাগ নির্ভুল ও শুদ্ধ হতে হবে। তাই সংবাদটি প্রকাশ বা প্রচারের আগে প্রতিটি তথ্য বারবার খতিয়ে দেখতে হবে (পযবপশ ্ ৎব-পযবপশ)। কোনো তথ্য নিয়ে মনে সন্দেহ থাকলে বা চেষ্টা করেও বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের অভাবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া না গেলে প্রয়োজনে তা বাদ দিতে হবে; কোনো অবস্থাতেই ‘অনুমান’ করে কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না। সাংবাদিকতায় একটি কথার চল রয়েছে : যিবহ রহ ফড়ঁনঃ, ষবধাব রঃ ড়ঁঃ. কোনো তথ্য নিয়ে মনে সন্দেহ থাকলে তা প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে হবে।
সাংবাদিকদের এই নেতা বলেন, গণমাধ্যম গণমানুষের কথা বলবে; আবার এই গণমানুষের কাছেই গণমাধ্যম দায়বদ্ধ থাকবে। এটি প্রত্যাশিত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সব সময় ক্ষমতাসীনদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে এবং ক্ষমতাসীনদের কাছে দায়বদ্ধ ছিল। এখন নতুন করে যোগ হয়েছে মালিকপক্ষ। মালিকদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে সত্যটা তুলে ধরছে না। অন্যদিকে যেসব গণমাধ্যম স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছে, তারা বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতির কারণে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানেও গণমাধ্যমের একটি অংশ জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এর ফলে বেশ কিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার আক্রমণের শিকারও হয়েছে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম সম্পর্কে গণমানুষের ধারণা যে ইতিবাচক নয়, সেটা সহজে অনুমান করা যায়। গণমাধ্যম সম্পর্কে গণমানুষের প্রকৃত ধারণা কী, তা জানার জন্য গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন জাতীয় পর্যায়ে একটি জনমত জরিপ পরিচালনা করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত এই জরিপে দেখা যায়, ৭৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ মানুষ গণমাধ্যমে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন, ৭১ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ সরকারি হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন এবং ৫০ দশমিক ১৪ শতাংশ মানুষ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন। ৩১ দশমিক ৩৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন, সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত স্বার্থ এই হস্তক্ষেপের জন্য দায়ী। ২৪ দশমিক ১৭ শতাংশ মানুষ মালিকের ব্যাবসায়িক স্বার্থ এবং ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ মানুষ বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপকে গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন