বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রতিটি বাঁক পরিবর্তনের পেছনে আছে জনতার রক্ত, আশা, এবং প্রতিরোধ। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থান এবং তার পরবর্তী রাজনৈতিক চুক্তি ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ সে ইতিহাসেরই সর্বশেষ অধ্যায়। এ সনদ যেমন ইতিহাসের এক গৌরবময় মুহূর্তকে ধারণ করে, তেমনি তা ভবিষ্যতের জন্য রেখে যায় এক গভীর দায় ও দায়িত্ব।
‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদলের দলিল। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও ২৫টি রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষরের মাধ্যমে এ সনদে যে জাতীয় ঐকমত্যের সূচনা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে এক নতুন দিগন্তের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু রাজনৈতিক ইচ্ছার এ ঘোষণা কেবলমাত্র একটি কাগজে সীমাবদ্ধ থাকলে তা জনগণের কাছে প্রত্যাশার অপমৃত্যু ছাড়া আর কিছুই হবে না।
এ সনদে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, রাষ্ট্র সংস্কার, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, শ্রমিক অধিকারের সুরক্ষা এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের শহিদদের সম্মানজনক স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বিশেষত পঞ্চম দফায় ‘জুলাই-যোদ্ধা’দের দায়মুক্তি, পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রতিশ্রুতি একটি সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু একই সঙ্গে এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আইনগত, সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর অস্পষ্টতা এবং অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমতের কারণে অনিশ্চয়তার ছায়াও সৃষ্টি করেছে।
এখানে মূল প্রশ্নটি হলো, এই সনদ কি বাস্তবে রূপ পাবে, নাকি অতীতের মতোই কেবল একটি রাজনৈতিক ইচ্ছাপত্রে পরিণত হবে? আমাদের ইতিহাসে এমন অনেক দলিল ও ঘোষণা এসেছে, যেগুলো রাজনৈতিক উত্তাপে জন্ম নিলেও প্রশাসনিক জড়তায় হারিয়ে গেছে। ১৯৯০-এর সর্বদলীয় চুক্তি, ২০০৮-এর জাতীয় ঐক্যের প্রতিশ্রুতি কিংবা ২০১৮ সালের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ঘোষণা সবই সময়ের গর্ভে হারিয়ে গেছে কার্যকারিতা ছাড়া।
এ প্রেক্ষাপটে জুলাই সনদের সার্থকতা নির্ভর করছে এর দ্রুত, কার্যকর ও স্বচ্ছ বাস্তবায়নের ওপর। জনগণ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রতারণা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও গণতন্ত্রের সংকট দেখেছে। তাই তারা আর প্রতিশ্রুতির মোহে বিভোর নয়, বরং চায় দৃশ্যমান পরিবর্তন, বাস্তবায়িত অঙ্গীকার।
আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রকাশ করতে হবে, যেখানে জানানো হবে এ সনদের প্রতিটি দফা কীভাবে, কোন আইন বা সংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, কোন সময়সীমায় বাস্তবায়ন হবে। এ রূপরেখার অংশ হিসেবে ‘অন্তর্বর্তী সংবিধানিক কমিশন’ গঠনের বিষয়টিও বিবেচনায় আনা যেতে পারে, যারা আইনি কাঠামো তৈরির কাজটি করবে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে।
এ ছাড়া এনসিপি ও চারটি বামপন্থি দলের অনুপস্থিতি এ ঐক্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাদের আপত্তিগুলোর সুনির্দিষ্ট আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে না পারলে ‘জাতীয় ঐকমত্য’ পুরোপুরি অর্থবহ হবে না। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সব মত ও শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
‘জুলাই-যোদ্ধা’দের আন্দোলনের স্বীকৃতি, গণঅভ্যুত্থানের শহিদদের মর্যাদা এবং রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার প্রতিফলন হিসেবে এ সনদ যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা হবে একটি নতুন বাংলাদেশের পথে সাহসী পদক্ষেপ। কিন্তু যদি তা বাস্তবায়নবিহীন থেকে যায়, তবে তা গণআকাক্সক্ষার প্রতি এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতাই হবে।
জুলাই সনদ ইতিহাসের একটি প্রতীকী মুহূর্ত, কিন্তু প্রতীক দিয়ে সমাজ বদলায় না। বদলায় কাজ দিয়ে, আইন দিয়ে, কাঠামোগত সংস্কার দিয়ে। আমাদের বহু প্রত্যাশা ভঙ্গের ইতিহাসে যদি এ সনদ বাস্তবায়িত হয়, তবে তা হবে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং জনগণের বিজয়ের এক বাস্তব প্রমাণ।
আমরা আশা করি, সরকার দ্রুত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। কেননা, এই ঐতিহাসিক সনদ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক ও সংবেদনশীল বাংলাদেশ গড়ে উঠবে, যা হবে শহিদদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা ও জনগণের কাছে করা প্রতিশ্রুতির পূরণ।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন