সিলেটের রেলপথই শুধু ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এই রুটে চলাচলকারী সব আন্তঃনগর ট্রেনের ইঞ্জিনও ব্যবহারের অনুপযোগী। সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রাম রুটের ট্রেন টানার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে পুরোনো মান্ধাতা আমলের ইঞ্জিন। যেসব ইঞ্জিন এখন তাদের জন্মদেশেও আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। বাংলাদেশেও ব্যবহারের উপযোগিতা হারিয়েছে বহুকাল আগে। এগুলো এখন রীতিমতো লক্কড়ঝক্কড়। এমনকি যে কয়টি আন্তঃনগর ট্রেন এই রুটে চলাচল করছে, তার সব কটি রেলের বগিগুলোও দেশের সবচেয়ে পুরোনো। জোড়াতালি এবং মেরামত শেষে নতুন করে রং দিয়ে এগুলো সিলেট রুটে দেওয়া হয়েছে। ফলে ইঞ্জিন ও বগি দুটিই পুরোনো আমলের হওয়ায় মাঝপথে ঘন ঘন বিকল হচ্ছে। তবু বাংলাদেশ রেলওয়ের কারোরই দৃষ্টি পড়ে না সিলেট রুটের দিকে। পুণ্যভূমি সিলেটে তীর্থ ট্যুরিজম এবং প্রাকৃতিকভাবে পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণের গন্তব্য হলেও বাংলাদেশ রেলওয়ের গুরুত্বের তালিকায় একে ফেলে রাখা হয়েছে একেবারের শেষের দিকে। এ জন্য যখনই দেশে ট্রেনের নতুন ইঞ্জিন বা বগি এনে নামানো হয়, এগুলো প্রথমে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম ও পশ্চিমবঙ্গের রেলপথে। তখন সেই রুটের পরিত্যক্ত ইঞ্জিন-বগি এনে জোড়া লাগানো হয় সিলেট রুটে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ রেলওয়েতে রয়েছে ৬৬০০, ৩২০০ সিরিজের অত্যাধুনিক ও শক্তিশালী ইঞ্জিন। তার আগের ৩১০০, ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিন দিয়েও বিভিন্ন রুটে রেলসেবা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে রেলওয়েতে সবচেয়ে পুরোনো হচ্ছে ২৯০০, ২৮০০ এমনকি ২৬০০ সিরিজের ইঞ্জিন বা লকো। এগুলোর একেকটির বয়স ৫৫-৬০ বছরেরও বেশি। ২৬০০ ও ২৮০০ সিরিয়ালের ইঞ্জিনগুলো পাকিস্তান আমলের। এগুলো বিভিন্ন রুটে মেইল, লোকাল ট্রেন এবং মালগাড়ি টানার জন্য ব্যবহার করা হলেও সিলেট রুট তার ব্যতিক্রম। সিলেট থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে যে ছয়টি আন্তঃনগর ট্রেন যাত্রীসেবা দিচ্ছে, তার সবগুলোই বাংলাদেশ রেলওয়ের ২৬০০, ২৮০০ ও ২৯০০ সিরিজের ইঞ্জিন। সিলেট-চট্টগ্রাম রুটের উদয়ন ও পাহাড়িকা এক্সপ্রেস চালানো হচ্ছে ২৬০০ সিরিজের ইঞ্জিন দিয়ে, যে ইঞ্জিন দিয়ে অন্য রুটের লোকাল ট্রেন চালানো হচ্ছে। অবশ্য এগুলো অনেক আগেই তার কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। একই রকম সিলেট রুটের রেলবহরের বগিগুলোও সবচেয়ে পুরোনো। সিলেটের সঙ্গে রেলের এই বিমাতাসুলভ আচরণের জন্য ক্ষোভ বাড়ছে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, সিলেট প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। প্রাকৃতিক এবং তীর্থ পর্যটনের স্বর্গভূমি হয়েও সিলেটকে দেখলে মনে হয় উন্নয়ন প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের রোল মডেল! বিশেষ করে সড়কযোগাযোগ, আকাশ ও রেলযোগাযোগের বিষয়ে যেন জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। এটি সুষম উন্নয়নের প্রশ্নে বিশাল একটি অন্তরায়। এ থেকে রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতে হবে। সিলেটের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এই মুহূর্তে সিলেট-ঢাকা রুটে চার জোড়া এবং সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে দুই জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করছে। সিলেট থেকে রাজধানী ঢাকা রুটে চলাচলকারী ট্রেনগুলো হচ্ছেÑ উপবন, জয়ন্তিকা, পারাবত ও কালনী এক্সপ্রেস। সিলেট-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী আন্তঃনগরগুলো হচ্ছেÑ উদয়ন ও পাহাড়িকা এক্সপ্রেস। এদের সঙ্গে আছে একজোড়া মেইল ট্রেন। প্রতিদিন ১২-১৫ হাজার যাত্রী সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রামে যাতায়াত করে। সিলেট রুটের সবচেয়ে নতুন ট্রেনটি হচ্ছে কালনী এক্সপ্রেস। ২০১২ সালের ১৫ মে ঢাকা থেকে সিলেটগামী কালনী এক্সপ্রেস চালু করা হয়। এরপর আর কোনো রেলসেবায় যায়নি কোনো সরকার। পরবর্তী সময়ে টাঙ্গুয়া এক্সপ্রেস চালুর ঘোষণা দিলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক রেলপথ সিলেট রুট। এর কারণ, ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইন, মান্ধাতা আমলের ইঞ্জিন ও বগি। ফলে খুব ঘন ঘন মাঝপথে ইঞ্জিন বিকল হয়ে আটকা পড়তে হয় যাত্রীদের। অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের অন্তঃনগর সব ট্রেনের জন্যই বাংলাদেশ রেলওয়ে বরাদ্দ রেখেছে দেশের সবচেয়ে পুরোনো লোকো ও ইন্দোনেশিয়ার তৈরি বগি। এসব বগি এখন ইন্দোনেশিয়া সরকারও তার দেশের জন্য ব্যবহার করছে না। সিলেট-ঢাকা রুটে চলাচলকারী সবচেয়ে নতুন আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ‘কালনী’ টানছে ২৯০০ সিরিজের ইঞ্জিন।
২৯২৮ ও ২৯২৮ নম্বরের ইঞ্জিন বরাদ্দ কালনীকে সিলেটে নিয়ে আসা এবং ঢাকায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। সবচেয়ে অভিজাত ট্রেন হিসেবে পরিচিত পারাবত এক্সপ্রেস টানছে আরও পুরোনো ২৯১৭ এবং ২৯১৫ নম্বরের ইঞ্জিন। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে সিলেট-চট্টগ্রাম রুটের ইঞ্জিনগুলোর অবস্থা। সেই রুটের উদয়ন এক্সপ্রেস চালানো হয় সবচেয়ে পুরোনো এবং অনেক আগে কার্যক্ষমতা হারিয়ে বসা ২৬০০ সিরিয়ালের ২৬০৭ নম্বরের ইঞ্জিন। এসব ইঞ্জিন দিয়ে অন্তঃনগরের মতো দ্রুতগতির ট্রেন সার্ভিস দিতে গিয়ে প্রতি সপ্তাহেই একাধিক ট্রেন মাঝপথে বিকল হয়ে বসে থাকার ঘটনা ঘটে।
কিছুদিন আগে সিলেট থেকে ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেসের বগি সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর কিছুদিন পরে গত বৃহস্পতিবার পাহাড়িকা এক্সপ্রেসে এমন ঘটনা ঘটে। কুলাউড়ার ভাটেরা স্টেশন অতিক্রম করার পর মোমিনছড়া চাবাগান এলাকায় দুটি বগির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গত ১৫ তারিখে সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন নরসিংদীতে বিকল হয়ে পড়ে। এর কয়েকি দন পূর্বে সিলেটগামী কালনী এক্সপ্রেস ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশনে পেছনের তিনটি বগি রেখে ছেড়ে দেয়। গত ৮ মে ২০২৫ তারিখে ঢাকা-সিলেট রুটে চলাচলকারী পারাবত এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে চার ঘণ্টা বসে ছিল মাঝপথে। এরকম ঘটনা সিলেটের জন্য এখন নিত্যদিনের। এভাবে প্রতিদিনই নতুন নতুন ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সিলেটের যাত্রীরা।
রেল সূত্র জানায়, পুরোনো বগি দিয়ে ট্রেন সার্ভিস দেওয়ার কারণে বগির সংখ্যা কমিয়ে নেওয়া হয়েছে রেলবহর থেকে, যাতে লক্কড়ঝক্কড় ইঞ্জিন দিয়ে বগিগুলো যাত্রীসেবায় রাখা যায়, সেই লক্ষ্যে বগি কমিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সর্বোচ্চ ১৫টি বগি দেওয়া হয় প্রতিটি ট্রেনের বহরে। আগে ২০ থেকে ২২টি ছিল।
সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনের কুলাউড়ার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর শাহজাহান পাটোয়ারি বলেন, দুর্বল ইঞ্জিনের কারণে মাঝেমধ্যে এমন ঘটনা ঘটে। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের লোকজন মেরামত করে আবার তা সচল করেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, সিলেট বিভাগ উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি চৌধুরী আতাউর রহমান আজাদ বলেন, ঢাকা-সিলেট রুটে আরও তিন জোড়া ট্রেন নতুন ইঞ্জিন ও বগিসহ চালু করা দরকার। সিলেট-কক্সবাজার রুটে অন্তত এক জোড়া ট্রেন নতুন ইঞ্জিন ও বগিসহ চালু করা হোক।
গ্লোবাল জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনও সিলেট রুটে রেলযাত্রা সুখকর ও নিরাপদ করার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনমত গঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন দাবিতে তারা আন্দোলনও করছে। সামাজিক এই সংগঠনের সেক্রেটারি কবি বায়েজিদ মাহমুদ ফায়সাল বলেন, সিলেট বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের যোগানদাতা। সিলেট পর্যটন অঞ্চল। সিলেট আধ্যাত্মিক নগরী। সিলেটকে বলা হয় দ্বিতীয় লন্ডন। অথচ এখানকার যোগযোগব্যবস্থা এতটাই নাজুক যে আমাদের প্রবাসীদের আসতে নিরুৎসাহিত করে এবং পর্যটকদের সিলেটবিমুখ হতে উৎসাহিত করে।
সিনিয়র সাংবাদিক শাখাওয়াত কাওসার বলেন, সিলেটবাসী ছাড়াও ঢাকায় বসবাসকারী জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনকে তাদের দাবি আদায়ে ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্তু এসব বিষয়ে তাদের ভূমিকা চোখে পড়ে না।
জাতীয় মাসিক পরওয়ানার সম্পাদক মাওলানা রেদওয়ান আহমদ চৌধুরী ফুলতলী বলেন, রেল নিয়ে আমাদের দুঃখ ঘোচানোর জন্য সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। এর বিকল্প নেই। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ইমাদ উদ্দিন নাসিরী বলেন, সিলেট রুটে পূর্বের লোকাল ট্রেনগুলো চালু ও ডাবল রেললাইন প্রতিস্থাপন করা জরুরি।
সিলেট রেলওয়ের স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, সিলেট সেকশনে ২৯০০ সিরিজের ইঞ্জিন চলছে। ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিন ট্রায়ালে আছে। এগুলো ট্রায়ালে সাপোর্ট পেলে সিলেট রুটে নামানো হবে। তবে এটি নির্ভর করবে রেলপথের ওপর। তিনি বলেন, বগি যা আছে, সেগুলো দিয়ে নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্নভাবে রেল সার্ভিস দেওয়া সম্ভব। শুধু ইঞ্জিনগুলো পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন