বগুড়ার শেরপুরের প্রাচীন সুলতানি আমলের স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন খেরুয়া মসজিদ। অবস্থানগত দিক থেকে এটি শেরপুর উপজেলা শহর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে শাহবন্দেগী ইউনিয়নের খন্দকারটোলায় অবস্থিত।
ফারসি শিলালিপিতে লেখা আছেÑ নবাব মির্জা মুরাদ খান কাকশালের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়। তবে সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণে তৈরি এই মসজিদের নামকরণের সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। ইতিহাস ও স্থাপত্যবিদ আবুল কালাম মুহাম্মদ জাকারিয়া তার ‘বাংলাদেশের প্রতœসম্পদ’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘খেরুয়া’ নামকরণের কারণ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। আরবি ভাষায় ‘খেরুয়া’ নামে কোনো শব্দ নেই। তবে ফারসিতে ‘খায়র গাহ’ নামে একটি শব্দ আছে, যার অর্থ ‘কোনো স্থানের ভেতরে’। ধারণা করা হয়, রাজা মানসিংহ যখন বাংলার সুবাদার ছিলেন, তখন তিনি শেরপুরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। সেই দুর্গের কোনো অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। যদি মসজিদটি সেই দুর্গের ভেতরে নির্মিত হয়ে থাকে, তবে ‘খায়র গাহ’ থেকে ‘খেরুয়া’ নামটি এসেছে বলে অনুমান করা হয়।
সবুজ ঘাসে ঘেরা মসজিদের চারপাশ সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রায় ৫৯ শতাংশ জমি নিয়ে গঠিত মসজিদের পুরো অংশ। ইটের দেয়ালের ওপর লোহার রেলিং দেওয়া রয়েছে। মূল গেটের কাছেই বড় একটি সাইনবোর্ডে বাংলা ও ইংরেজিতে মসজিদের ইতিহাস লেখা আছে।
মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের ঐতিহ্যের সন্ধান এবং অধ্যক্ষ মুহাম্মদ রুস্তম আলীর শেরপুরের ইতিহাস (অতীত ও বর্তমান) গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়Ñ ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে স্থানীয় বুজুর্গ ফকির আবদুস সামাদ একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। সে সময় এখানকার প্রাদেশিক জায়গিরদার মির্জা মুরাদ খান কাকশালের পৃষ্ঠপোষকতায় মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয়। দিল্লির সিংহাসনে তখন মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন আকবর। ১৫৮২ সালে তিনি ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’ প্রবর্তন করলে বাংলার কিছু অঞ্চলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেয়। মির্জা মুরাদ খান কাকশালও সম্রাটের বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেন। বিদ্রোহের সময় মসজিদের কাজ বন্ধ থাকে। পরবর্তী সময়ে তিনি সম্রাটের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে আবার মসজিদের কাজ শুরু হয়। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ বছর সময় লাগে মসজিদটির নির্মাণ সম্পন্ন হতে।
মসজিদটি একটি আয়তাকার স্থাপত্য। এর দৈর্ঘ্য ১৭ দশমিক ৬৭ মিটার এবং প্রস্থ ৭ দশমিক ৬২ মিটার; দেয়ালের পুরুত্ব ১ দশমিক ৯৫ মিটার। পূর্ব দিকে তিনটি প্রবেশদ্বার আছেÑ এর মধ্যে কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বারটি বড় ও প্রশস্ত। প্রতিটি প্রবেশদ্বারের অভ্যন্তর দিকের দেয়ালে রয়েছে তিনটি মিহরাব। আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে অর্ধগোলাকার মিহরাবগুলো স্থাপিত এবং সেগুলোর কারুকার্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।
মসজিদের চার কোণে রয়েছে মিনার, যা স্থাপনাকে আরও সুদৃঢ় করেছে। এর কার্নিশগুলো সুলতানি আমলের মতো বাঁকানো, যাতে ছাট ছাট পোড়ামাটির অলংকরণ রয়েছে। অর্ধগোলাকার গম্বুজগুলোর কার্নিশও ধনুকের মতো বাঁকানো। ভেতরের পশ্চিম দেওয়ালে তিনটি অর্ধগোলাকার কারুকাজযুক্ত মিহরাব রয়েছেÑ মূল মিহরাবের দুপাশে ছোট দুটি মিহরাবও আছে সৌন্দর্য ও সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য। মসজিদটি ইট, চুন ও সুরকি দিয়ে গাঁথা; পাশাপাশি বহু স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে কষ্টিপাথর। ইটের বিন্যাস, খাড়া প্যানেল, গম্বুজ, মিনার, লতাপাতা ও ফুলের নকশাÑ সব মিলিয়ে মসজিদটি এক অনন্য নান্দনিক স্থাপত্যে পরিণত হয়েছে।
খেরুয়া মসজিদের খাদেম আব্দুস সামাদ বলেন, ‘প্রতিদিন দেশ-বিদেশের বহু ভ্রমণপিপাসু মানুষ মসজিদ দেখতে আসেন। দর্শনার্থীরা মুসলিম স্থাপত্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন। তবে মসজিদের রাস্তা সংস্কার এবং আশপাশে বড় বড় ভবন নির্মাণ বন্ধ করা গেলে পর্যটক আরও বাড়বে।’
মসজিদের মুয়াজ্জিন জোবায়ের বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি এখানে তারাবিহ ও ঈদের জামাতও অনুষ্ঠিত হয়। তবে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ থেকে মসজিদটি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’
চার শতাধিক বছর আগে নির্মিত এই খেরুয়া মসজিদের এখন জরুরি ভিত্তিতে পুনঃসংস্কার প্রয়োজন। পর্যটক ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা তৈরি করতে পারলে খেরুয়া মসজিদটি ইতিহাস-ঐতিহ্য আরও কাছে থেকে দেখার সুযোগ দেবে।
        
                            
                                    
                                                                
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
                                    
                                    
                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                            
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন