ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৫

১৬ বছরে ১২ বার আগুন

অগ্নিঝুঁকিতে বেনাপোল স্থলবন্দরের পণ্যাগার

বেনাপোল প্রতিনিধি
প্রকাশিত: নভেম্বর ৬, ২০২৫, ১২:৩৫ এএম

** ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ, নিরাপত্তা জোরদার

গত ১৬ বছরে যশোরের বেনাপোল বন্দরের গুদামে ১২ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। ঢাকার বিমানবন্দর কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার পর বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা বলছেন, পরিকল্পিত নাশকতা যাতে না ঘটে সে জন্য বন্দর ও পুলিশ প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন, ঢাকায় আগুন লাগার পর তারা আরও বেশি সতর্ক হয়েছেন। কড়া নজরদারি করার পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা।

গত বৃহস্পতিবার থেকে পরিচয়পত্র ছাড়া বন্দরে প্রবেশ বন্ধ করতে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। বন্দরের মধ্যে ধূমপান, আগুনের ব্যবহার নিষিদ্ধ ও ফায়ার সিস্টেম সচল রাখতে নিয়মিত পরীক্ষা করা হচ্ছে। বেনাপোল ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে নিরাপত্তাঝুঁকির কথা বলে এসেছে। তাদের পর্যবেক্ষণ হলোÑ বেনাপোল বন্দরে অগ্নিনিরাপত্তা যথেষ্ট নেই।

দেশের বৃহত্তর স্থলবন্দর বেনাপোলের অধিকাংশ গুদাম এবং ওপেন ইয়ার্ডে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। যে কারণে পণ্যাগার অগ্নিকা-ের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া বন্দরের ফায়ার স্টেশনে জনবল কম থাকায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত সময়ে তারা আগুন নেভাতে পারে না। জনবল বাড়ানো দরকার। বন্দরে জায়গা সংকটের কারণে আমদানি করা দাহ্যপণ্যের পাশাপাশি সাধারণ পণ্য রাখা হচ্ছে। এতে অগ্নিকা-ের ঝুঁকি বাড়ছে।

সর্বশেষ গত ২০২২ সালের ২৬ আগস্ট বন্দরের ৩৫ নম্বর শেডে আগুন লেগে কোটি টাকার আমদানি করা পণ্য পুড়ে যায়। এ জন্য অগ্নিকা-ের ঝুঁকির কথা জানিয়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।

বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ২০ লাখ ১১ হাজার ২৬৮ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। একই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪ লাখ ২১ হাজার ৭১৩ মেট্রিক টন পণ্য।

বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিবছর বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার আমদানি ও ৮ হাজার কোটি টাকার রপ্তানি বাণিজ্য হয়। সব সময় বন্দরটিতে প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন পণ্য মজুত থাকে। যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এ পথে সবচেয়ে যেমন বেশি বাণিজ্য হয়, তেমনি অগ্নিকা-ও বেশি ঘটে বন্দরটিতে। প্রতিবছরই কখনো পণ্যাগারে, কখনো পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন লাগতে দেখা যায়। গত ১৬ বছরে বেনাপোল বন্দরে বড় ধরনের ১২টি অগ্নিকা-ের ঘটনায় আমদানিপণ্য পুড়ে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয় ব্যবসায়ীদের। বন্দরের সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বারবার। তবে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় আগুনের ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে বন্দর কর্তৃপক্ষকে। এতে জোরদার করা হয়েছে সুরক্ষাব্যবস্থা। বন্দর ব্যবহারকারী বাণিজ্যিক সংগঠন ও কাস্টমসের সঙ্গে বৈঠক করে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অগ্নিনির্বাপণকর্মীদের সচেতন থাকতে বলা হয়েছে। বন্দরে প্রবেশকারীদের সঙ্গে থাকা ব্যাগ তল্লাশি করে বন্দর অভ্যন্তরে অনুমতি মিলছে।

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, বন্দরের গুদামে বারবার আগুন লাগলেও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় প্রতিবারই আগুন নেভাতে ব্যর্থ হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। দমকল বাহিনী ডেকে আগুন নেভাতে হয়। এর আগেই পুড়ে যাচ্ছে আমদানি করা কোটি কোটি টাকার পণ্য। আগুনে পণ্য পুড়লেও ক্ষতিপূরণ পাননি আমদানিকারকেরা। ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, কিন্তু সে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয় না কখনোই।

বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বেনাপোল বন্দরে ৩৮টি গুদাম ও ওপেন ইয়ার্ড রয়েছে। এখানে ধারণক্ষমতা ৪৭ হাজার ৪৪০ টন পণ্য। কিন্তু রাখা হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ টন। গাদাগাদি করে পণ্য রাখার কারণে অগ্নিঝুঁকি আরও প্রকট হয়েছে।

জানা যায়, বন্দরের পণ্যাগারে দীর্ঘদিন ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ নিলামযোগ্য পণ্যের পরিমাণ ১২ হাজার ৬৫৯ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ৩ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ ঝুঁঁকিপূর্ণ বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য। এসব রাসায়নিক পণ্য অগ্নিকা-ের ঝুঁঁকি বাড়াচ্ছে।

এ ব্যাপারে বেনাপোলে বন্দর ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, গত ১৬ বছরে বন্দরে অন্তত ১২ বার আগুন লেগেছে। এতে শত শত কোটি টাকার পণ্য পুড়ে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। প্রায়ই বন্দরের গুদাম থেকে পণ্য চুরি হচ্ছে। বন্দরের প্রতিটি গুদাম ও ওপেন ইয়ার্ড অগ্নিকা-ের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ জন্য নজরদারি বাড়ানোর সাথে অগ্নিনিরাপত্তা বাড়াতে হবে। কেননা দেশবিরোধীরা নাশকতা ঘটাবে না, এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

বেনাপোল ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মফিজুর রহমান বলেন, বন্দরে পণ্য রাখার জায়গা বাড়াতে হবে। অতিদাহ্য পণ্য নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। আগুন নেভানোর জন্য নিজস্ব ব্যবস্থা থাকতে হবে। বন্দরের পণ্যাগারে দীর্ঘদিন ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ নিলামযোগ্য পণ্যের দ্রুত অপসারণ করা দরকার।

যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও আমদানিকারক মিজানুর রহমান খান জানান, এর আগে কয়েকবার আগুন ধরে ব্যবসায়ীরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। আমরা বারবার বলার পরও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ব্যবসায়ীরা সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছেন, বন্দরের ভাড়া প্রদান করছেন অথচ তাদের আমদানি করা পণ্যের নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না। রহস্যজনক কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ এসব পণ্যের বিমাও করে না। বেনাপোল বন্দর অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এ জন্য কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে হবে। পুরো বন্দর সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে হবে।

বেনাপোল ফায়ার সার্ভিসের ইনচার্জ বায়েজিদ বোস্তামি জানান, গত ৩০ সেপ্টেম্বর আমরা বেনাপোল বন্দরের গুদামগুলো পরিদর্শন করেছি। ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫ ও ৩৮ নম্বর শেডে কেমিক্যাল রাখা হয়। সেখানে ওই সময় ২৬ লাখ ৭১ হাজার ৬৫১ কেজি কেমিক্যাল-জাতীয় পণ্য ছিল। চাহিদা অনুযায়ী সব সময় একই ওজনের কেমিক্যাল আমদানি হয়ে থাকে। বন্দরের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল। আমরা দাহ্য পদার্থ কীভাবে রাখতে হয় তার সঠিক দিকনির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি।

অগ্নিকা-ের দুর্ঘটনা এড়াতে ফায়ার সিস্টেম নিয়মিত পরীক্ষা করা হচ্ছে। ৯০ একর জায়গায় স্থাপিত বেনাপোল বন্দরে অগ্নিকা- প্রতিরোধে ২টি ফায়ার স্টেশনে মাত্র ৭ জন জনবল রয়েছে। এটা বাড়ানো হলে আরও বেশি নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব।

বেনাপোল বন্দরের ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান জানান, এত বড় স্থলবন্দরে মাত্র ছয়জন জনবল নিয়ে তাকে কাজ করতে হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনা ঘটলে আগুন নেভাতে বিলম্ব হয়। বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানালেও এখন পর্যন্ত জনবল নিয়োগ হয়নি।

এ ব্যাপারে বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক শামিম হোসেন রেজা বলেন, অগ্নিঝুঁকি নেই এই কথা বলব না। তবে কেউ যাতে নাশকতা করার চেষ্টা না করতে পারে সে জন্য কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা বা নাশকতা রোধে পোশাকধারী নিরাপত্তাকর্মীদের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও রয়েছে নজরদারি। বন্দর সচল রাখার সাথে আগুন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে হাই এলার্ট জারি করেছি। প্রতিটি গুদামে ফায়ার হাইডেন পয়েন্ট ও ফায়ার পাম্প রয়েছে।

এ ছাড়া বন্দরে পড়ে থাকা নিলাম ও ধ্বংসযোগ্য ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য কাস্টমসকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরাতে বা ধ্বংস করতে অনুরোধ করা হয়েছে। বন্দরের মধ্যে আগুন ব্যবহার ও কার্ডধারী ছাড়া প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।