বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু কৃষির উন্নয়নই যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে পুষ্টি ও লিঙ্গ (জেন্ডার) বিষয়ক সচেতনতা যুক্ত হলেই পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বা বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি, অসুস্থতাজনিত অবস্থায় আর্থিক চাপ সামলে টিকে থাকার ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদে বাড়ে। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইএফপিআরআই) এক নতুন গবেষণায় এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষকদের মতে, গ্রামীণ অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে শুধু কৃষি নয়, পুষ্টি ও লিঙ্গ বিষয়ে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ। আর আইএফপিআরআইয়ের লক্ষ্য হলোÑ গবেষণার মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস করা এবং ক্ষুধা-পুষ্টিহীনতা দূরীকরণের জন্য সমাধান বের করা। এই গবেষণাপত্রটি প্রমাণ করে যে, টেকসই উন্নয়নের জন্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবারের ভেতরে পুষ্টির সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ (জেন্ডার ইকুয়ালিটি) নিশ্চিত করা জরুরি।
বিশ্বের শীর্ষ কৃষি গবেষণা সংস্থা সিজিআইএআর-এর অংশ হিসেবে আইএফপিআরআই কর্তৃক প্রকাশিত ‘ডিসকাশন পেপার ০২৩৭৫’ গ্রামীণ পরিবারের ওপর পরিচালিত উন্নয়ন কর্মসূচিগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মূল্যায়ন করেছে। কর্নেল ইউনিভার্সিটির ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন ইকোনমিকসের অধ্যাপক জন হডিনট, আখতার আহমেদ, এম. মেহরাব বখতিয়ার এবং অ্যাগনেস কুইসাম্বিং এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন।
গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল, গ্রামীণ পরিবারগুলো বিভিন্ন ধরনের অপ্রত্যাশিত অর্থনৈতিক বা প্রাকৃতিক ধাক্কা (যেমন ফসলহানি বা অসুস্থতাজনিত আর্থিক চাপ) মোকাবিলা করে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান কতটা ধরে রাখতে পারেÑ সেই সহনশীলতা পরীক্ষা করা।
গবেষক দল ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ৬০০টিরও বেশি পরিবারকে তিনটি ভিন্ন দলে ভাগ করে এর প্রভাব তুলনা করেছে। সেগুলো হলোÑ কৃষি সহায়তা, কৃষি ও পুষ্টি সহায়তা এবং কৃষি, পুষ্টি ও লিঙ্গবিষয়ক সমন্বিত সহায়তা।
গবেষণায় দেখা গেছে, যে পরিবারগুলো ‘কৃষি, পুষ্টি ও লিঙ্গ’Ñ এই তিনটি বিষয়েই সমন্বিত প্রশিক্ষণ ও হস্তক্ষেপ পেয়েছিল, যেকোনো সংকটে তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অন্য দলগুলোর তুলনায় সবচেয়ে বেশি ছিল। কর্মসূচি শেষ হওয়ার চার বছর পরেও (২০২২ সাল পর্যন্ত), তাদের টিকে থাকার ক্ষমতা উন্নত অবস্থায় ছিল। এর অর্থ হলোÑ এই ধরনের পরিবারগুলো যেকোনো অর্থনৈতিক ধাক্কা, এমনকি বন্যা বা খরার মতো দুর্যোগের পর নিজেদের জীবনযাত্রার মান সহজে পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে।
গবেষকদের মতে, ভবিষ্যতে দারিদ্র্য বিমোচন এবং খাদ্য নিরাপত্তামূলক প্রকল্পগুলোতে শুধু ফলন বৃদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে কৃষি, পুষ্টি ও জেন্ডার ইস্যুগুলোকে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে যুক্ত করা উচিত। পরিবারে পুষ্টির জ্ঞান বৃদ্ধি এবং আর্থিক সিদ্ধান্তে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হলে বাংলাদেশের প্রান্তিক পরিবারগুলো যেকোনো অপ্রত্যাশিত ধাক্কা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে এবং দীর্ঘমেয়াদে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।
গবেষণা শেষে গবেষকরা তাদের মতামত তুলে ধরে বলেন, ভবিষ্যতে দারিদ্র্য বিমোচন এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উচিতÑ শুধু ফলন বৃদ্ধি নয়, বরং পরিবারভিত্তিক পুষ্টি ও লিঙ্গসচেতন সমন্বিত প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করা। এটি বাংলাদেশের প্রান্তিক পরিবারগুলোকে যেকোনো অপ্রত্যাশিত অর্থনৈতিক ধাক্কা থেকে রক্ষা করতে এবং দীর্ঘমেয়াদে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করবে।

