ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালে দেখা যায়, কোনো বিপ্লবই সাময়িক কোনো কারণে নয় বরং দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ, অত্যাচার-নিপীড়ন কিংবা বঞ্চনার ফল। সেই অর্থ জুলাই আন্দোলনও একই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। কিন্তু জুলাই আন্দোলন শুধু কোটা প্রথার বিলোপ চেয়ে শেষ হয় একটা স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। যার ফলে এ আন্দোলন ছাত্র আন্দোলন থেকে গণআন্দোলনে রূপ নেয়। যদিও এ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল আওয়ামী সরকারের পতন। কিন্তু জনগণের মূল প্রত্যাশা ছিল একটা স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচবে, দ্রব্যমূল্যের দাম নাগালে থাকবে, যেকোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ বিশ্বাস করতে পারবে কিংবা নারীরা নির্বিঘেœ হাঁটতে পারবে। অথচ কিছু সংস্কার করা হলেও এখনো বেশির ভাগ সংস্কারই বাকি রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের ইতিহাস গণআন্দোলনের ইতিহাস। সেই তিতুমীরের বিদ্রোহ থেকে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৯১-এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলন পেরিয়ে সর্বেশেষ ’২৪-এর জুলাই আন্দোলন। আন্দোলন এদেশের মানুষের অস্থিমজ্জা গ্রোথিত হয়ে আছে। কিন্তু আন্দোলনের পরে কি জন্য আন্দোলন করা হলো, তাই ভুলে যায়। যার দরুন ’২৪-এর জুলাই আন্দোলন পরবর্তী এক কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এখন নিজের স্বাধীনতা ভোগ করতে গিয়ে অন্যের স্বাধীনতা নষ্ট করছি।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে সারা দেশে ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, দাঙ্গা, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধে ৯১ হাজার ৩৩৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে খুনের মামলা রয়েছে ১ হাজার ৯৩৩টি এবং ধর্ষণের মামলা ২ হাজার ৭৪৪টি। সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশ বিগত ৫ বছর এবং ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুনে বিভিন্ন অপরাধের দায়ে রুজু করা সকল মামলার পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে এনেছে। এ পরিসংখ্যানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এত এত অপরাধ কিন্তু বিচার পেয়েছে কতজন? কত ধর্ষিতা নারী আত্মহত্যা করেছে কিন্তু কতজন ধর্ষককে শাস্তি দেওয়া হয়েছে কিংবা সিসিটিভি ফুটেজ বা প্রত্যক্ষভাবে মানুষ খুন করার পরেও কতজন অপরাধী ন্যায্য শাস্তি পেয়েছে? শাস্তি না পেয়ে বরং বেশিরভাগ অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে আলোচনা হয়। প্রমাণ হয় সে কোনো দলের আর হয় বহিষ্কার।
কিন্তু এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিচার বিভাগের ব্যর্থতা নাকি অবহেলা? দেশের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, অপরাধীকে সাজা দিয়ে সমাজে অপরাধ দমন করাই বিচার বিভাগের কাজ। এদিকে বর্তমানে তা প্রায় পুরোটাই ব্যর্থ বলা চলে। অন্ততপক্ষে, অপরাধীকে দ্রুততম সময়ে গ্রেপ্তার করে বিচার করলে অপরাধীরা এমন চরম আচরণ করতে পারত না।
শোনা যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাদ তবে জুলাই যোদ্ধাদের কোটা দেওয়া হবে। কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এক কোটা বাতিল করে অন্য কোটা বহাল করা আন্দোলনকারীদের গাদ্দারি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
জুলাই শুধু সরকার পতনের জন্য হয়নি, বরং দেশের মানুষকে নতুন করে বেঁচে থাকর স্বপ্ন দেখায়। আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই স্বপ্নের সবচেয়ে বড় বাধা। সম্মিলিত প্রয়াসে এবং সর্বোচ্চ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি তা সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে।
ফলে অন্য অপরাধীরা এ ধরনের অপরাধ করতে পিছ পা হবে। একটা সুন্দর বাংলাদেশ হবে। জুলাই শুধু সরকার পতনে নয় বরং দেশকে পুনর্গঠনের নতুন এক অধ্যায়। জুলাইয়ের প্রত্যয়কে সরকার, জনগণ ও সকল রাজনীতিবিদকে মনেপ্রাণে ধারণ করতে হবে। সরকার, জনগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই পারে বাংলাদেশকে বাসযোগ্য দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে।
আপনার মতামত লিখুন :