ঢাকা শনিবার, ০২ আগস্ট, ২০২৫

মতামত

উত্তরবঙ্গ: দারিদ্র্য, নদীভাঙন ও উন্নয়নের অব্যক্ত ব্যথা

মো. শামীম মিয়া
প্রকাশিত: আগস্ট ১, ২০২৫, ১২:৪৮ পিএম
নদীভাঙনের চিত্র। ছবি- সংগৃহীত

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, বা ‘উত্তরবঙ্গ’, দীর্ঘদিন ধরে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাইরে পড়ে আছে। এখানে রয়েছে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র এবং উন্নয়নে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলো। রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, পঞ্চগড়, বগুড়া, জয়পুরহাট, ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ ১৬টি জেলা নিয়ে গঠিত এই অঞ্চল বহু ধরনের সংকটের মুখোমুখি। এই সংকটগুলো শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক, পরিবেশগত ও মানবসম্পদ সম্পর্কিত।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও উত্তরের এই অঞ্চলগুলোর অধিকাংশ গ্রাম ও শহর এখনো অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। দারিদ্র্য, নদীভাঙন, কৃষির অনিশ্চয়তা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং কর্মসংস্থান সংকট একসঙ্গে মিলেমিশে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। এই উপ-সম্পাদকীয়তে উত্তরবঙ্গের বর্তমান সমস্যা, তার প্রভাব, সম্ভাবনা ও করণীয় নিয়ে বিশ্লেষণ করব।

দারিদ্র্যের গভীরতা ও চিত্র

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ইইঝ) ২০২৪ সালের ‘হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে’ অনুযায়ী, দেশের গড় দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ হলেও উত্তরের কিছু জেলার দারিদ্র্যের হার চরমভাবে বেশি। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও রংপুর জেলায় দারিদ্র্যের হার ৩০-৪২ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে, যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণেরও বেশি। এই অবস্থা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও পরিসংখ্যান থেকে নিশ্চিত হয়।

উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর হলেও, কৃষি কার্যক্রম মৌসুমভিত্তিক এবং ঝুঁকিপূর্ণ : বন্যা, খরা, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষকের জীবিকা বিপর্যস্ত করে তোলে। এতে করে কৃষি শ্রমিক ও ক্ষুদ্র কৃষকেরা বারবার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আয় অস্থিরতার কারণে এই অঞ্চলের মানুষ ঋণগ্রস্ত এবং উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হন, যা তাদের দারিদ্র্যের গহ্বরে আরও গভীরভাবে ঠেলে দেয়।

বিশ্বব্যাংকের একটি সমীক্ষায় বলা হয়, কৃষিনির্ভর পরিবারের ‘মৌসুমি দারিদ্র্য’ বা মৌসুমি দারিদ্র্যের মাত্রা বিশেষ করে এপ্রিল-মে ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সর্বোচ্চ হয়ে থাকে। এই সময়গুলোতে কৃষি জমি প্রস্তুত বা ফসল কাটার জন্য অপেক্ষা করায় কর্মসংস্থান কমে যায়, এবং মানুষের খাদ্য ও আয় নিরাপত্তায় সংকট তৈরি হয়।

নদীভাঙনের ভয়াবহ বাস্তবতা:

নদীভাঙন উত্তরের মানুষের এক দীর্ঘমেয়াদি অভিশাপ। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, করতোয়া ও যমুনার মতো বড় নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলো প্রতিবছর নদীভাঙনের কবলে পড়ে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর প্রায় ১০,০০০ পরিবার এই অঞ্চলে নদীভাঙনের কারণে গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুত হয়। নদীভাঙনের ফলে বহু ফসলি জমি, বসতবাড়ি, বিদ্যালয় ও অন্যান্য সামাজিক অবকাঠামো বিলীন হয়ে যায়। এই বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো সাধারণত শহরের বস্তি, রেললাইনের ধারে কিংবা অন্যের জমিতে আশ্রয় নেন, যেখানে জীবন-যাত্রার মান অত্যন্ত নিন্ম।

নদীভাঙনের কারণে শিক্ষা ব্যাহত হয়, শিশু শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়ে, নারীরা নানা সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির মুখে পড়ে। এ ছাড়া, নদীভাঙনের কারণে অনেকে গরিবত্ব ও ক্ষুধার সম্মুখীন হয়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (ওঙগ) ২০২৩ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে, যার অধিকাংশই উত্তরবঙ্গের নদীভাঙনপ্রবণ এলাকা থেকে আসবে।

কৃষির অনিশ্চয়তা ও কর্মসংস্থান সংকট:

উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির মেরুদ- কৃষি হলেও আধুনিক প্রযুক্তি, সেচ সুবিধা, বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাব কৃষকের আয়কে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। কৃষকেরা প্রায়শই ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশা-নির্জনতায় পতিত হন। তিস্তা নদীর পানির সংকট ও ব্যারাজের অপর্যাপ্ত কার্যক্রম কৃষি উৎপাদনে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সঙ্গে পানি সম্পর্কিত সমস্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন কৃষি খাতকে ক্রমশ অনিশ্চিত করে তুলেছে।

তবে শুধু কৃষি নয়, শিক্ষিত তরুণদের জন্য উত্তরবঙ্গে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই। প্রতিবছর লাখ লাখ যুবক-যুবতী কাজের সন্ধানে ঢাকাসহ দেশের বড় শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন। অনেকেই সীমান্ত পেরিয়ে অনিয়মিত শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন, যা সমাজে অপরাধ, মাদকাসক্তি ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি উত্তরের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যসেবার দুরবস্থা:

উত্তরবঙ্গের অবকাঠামো দেশীয় গড়ের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। গ্রামীণ রাস্তা ও সেতুর অভাবে বর্ষাকালে যোগাযোগ ব্যাহত হয়। জেলা শহরের বাইরে সড়ক সংযোগ দুর্বল থাকায় কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ কঠিন হয়। বিদ্যুৎ সরবরাহ অসম্পূর্ণ, যা শিল্পায়ন ও শিক্ষাব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি করে। স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা অত্যন্ত আশংকাজনক। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় ডাক্তার ও ওষুধের অভাব প্রকট। বিশেষত দুর্গম অঞ্চলে সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। শিশু মৃত্যুহার ও মাতৃমৃত্যুর হার উত্তরবঙ্গে দেশের গড়ের চেয়ে বেশি। রংপুর মেডিকেল কলেজ ব্যতীত বড় হাসপাতালের ঘাটতি রয়েছে

শিক্ষাব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ:

শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া উত্তরবঙ্গের প্রধান সমস্যা ঝরে পড়ার হার। ইঅঘইঊওঝ-এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়ার হার প্রায় ১৪.১৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৩৫.৬৬ শতাংশ। নদীভাঙন ও দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না। মেয়েদের শিক্ষায় বাধা দেয় পরিবারিক সংকট ও সামাজিক প্রথা, যা বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ। শিক্ষক সংকট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও অনুপস্থিত পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার মান হ্রাস করেছে। উচ্চশিক্ষার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত প্রতিষ্ঠান না থাকায় শিক্ষার্থীরা ঢাকাসহ বড় শহরে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন, যা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উত্তরে খরা, বন্যা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত বেড়েছে। তিস্তা নদীর পানির সংকট ও ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার উত্তরবঙ্গের কৃষিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। শুষ্ক মৌসুমে সেচের অভাবে ফসল কম উৎপাদিত হচ্ছে, অন্যদিকে বর্ষায় প্লাবনে ফসল নষ্ট হচ্ছে। এই অনিশ্চিত আবহাওয়া কৃষকের জীবন ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি।

সম্ভাবনা ও উন্নয়নের পথ: যদিও উত্তরবঙ্গ আজও সংকটের মধ্যে, এটি সম্ভাবনায় ভরপুর। পঞ্চগড়ের চা, রাজশাহীর আম, দিনাজপুরের লিচু, ঠাকুরগাঁওয়ের আলু ও গম দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। নদীমাতৃক পরিবেশে ইকো-ট্যুরিজম ও জৈব কৃষির সুযোগ রয়েছে। আইটি পার্ক, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ক্ষুুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব।

সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে:

নদীভাঙন রোধে টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ বরাদ্দ, কৃষি আধুনিকায়ন ও বাজারব্যবস্থা উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন- রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন, জলবায়ু অভিযোজন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা। উত্তরবঙ্গ বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল স্তম্ভ হতে পারে, যদি এই অঞ্চলকে মূল স্রোতে যুক্ত করা হয়। দীর্ঘদিনের অবহেলা ও বৈষম্যের চক্র ভাঙতে দরকার পরিকল্পিত, টেকসই ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন।

সময় এসেছে উত্তরের মানুষের দুঃখ-কষ্ট শোনার, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার এবং দেশের সমগ্র উন্নয়নের অংশ হিসেবে তাদের ক্ষমতায়নের। দেশের সার্বিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে যাতে উত্তরবঙ্গও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ এর সাফল্যের গল্পের অংশ হয়ে ওঠে।

লেখক- প্রাবন্ধিক ও শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ,
জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা