ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এখন নতুন দিগন্তে। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সার্ভিস স্টারলিংক (ঝঃধৎষরহশ)-এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লাইসেন্স প্রাপ্তি, কেবল একটি প্রযুক্তিগত অনুমোদন নয়, বরং বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
গত ২৮ এপ্রিল, অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান, চিফ অ্যাডভাইজার প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার স্টারলিংকের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অনুমোদন দেয়। এটি ছিল জুলাইয়ের গণ-আন্দোলনের পর দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি, যা স্বল্প সময়ের মধ্যেই বাস্তব রূপ লাভ করে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় দেশ হিসেবে স্টারলিংককে স্বাগত জানাল, এর আগে দক্ষিণ এশিয়া এর মধ্যে শ্রীলঙ্কা প্রথম। যা ডিজিটাল সংযুক্তির ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে।
কেন স্টারলিংক এত গুরুত্বপূর্ণ?
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ডিজিটাল বৈষম্য, দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ এবং বিশেষত গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকায় সীমিত নেটওয়ার্ক কাভারেজের সমস্যায় ভুগছে। ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের সীমাবদ্ধতা, ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং মোবাইল টাওয়ারগুলোর ওপর নির্ভরতা দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামোকে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এখানেই স্টারলিংকের গুরুত্ব। এই স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা প্রচলিত সমস্যার সমাধান করে দেশজুড়ে নিরবচ্ছিন্ন, উচ্চ-গতির ইন্টারনেট সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের অনুমোদন। মাত্র ৯০ দিনের মধ্যে এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করে তারা প্রমাণ করেছে, দেশের জরুরি চাহিদা পূরণে তাদের দৃঢ় সংকল্প রয়েছে। মধ্য মে মাস থেকে স্টারলিংকের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা। প্রথম ৯০ দিনের জন্য সরকার স্থানীয় গেটওয়ে ছাড়াই স্টারলিংককে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে, যা দুর্গম এলাকার জরুরি ইন্টারনেট চাহিদা পূরণের গুরুত্বের প্রমাণ।
পোস্ট, টেলিযোগাযোগ ও আইটি বিষয়ক চিফ অ্যাডভাইজরের স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ফাইজ আহমেদ তাইয়েব জানান, জুলাই বিপ্লবের সময় বারবার ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট হওয়ার পর জনগণের পক্ষ থেকে নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেটের জন্য ব্যাপক চাহিদা ছিল। স্টারলিংকের আগমন কেবল একটি কারিগরি সমাধান নয়, এটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা যে বাংলাদেশ উদ্ভাবনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। এই প্রযুক্তি দুর্গম হাওর অঞ্চল, পার্বত্য এলাকা, দ্বীপ এবং দুর্যোগ-প্রবণ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কাছেও উচ্চ-গতির ইন্টারনেট পৌঁছে দেবে।
প্রচলিত সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে স্টারলিংক
স্টারলিংকের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর স্থিতিশীলতা। প্রচলিত ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (ওঝচ) বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে প্রায়শই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক মোবাইল টাওয়ার এখনো বিদ্যুৎনির্ভর, যা লোডশেডিংয়ের সময় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। স্টারলিংক তার স্যাটেলাইট-ভিত্তিক পরিষেবার কারণে এই সমস্যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এটি সরাসরি মহাকাশ থেকে সংকেত গ্রহণ করে, তাই বিদ্যুৎ অবকাঠামো বা ফাইবার অপটিক ক্যাবলের ওপর নির্ভর করতে হয় না।
বর্তমানে, বাংলাদেশের প্রায় ৬৫% টেলিকম টাওয়ার এখনো ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের আওতায় আসেনি, যা উচ্চ-গতির ইন্টারনেট সরবরাহের পথে একটি বড় বাধা। স্টারলিংক এই অবকাঠামোগত ঘাটতি সরাসরি পূরণ করবে, কারণ এটি স্থলভাগের নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল নয়। এই প্রযুক্তি কেবল ইন্টারনেটকে সহজলভ্য করবে না, বরং দেশের টেলিকম সেক্টরে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করবে। ফাইজ আহমেদ তাইয়েবের মতে, প্রচলিত ভয়েস/ডেটা বান্ডেলের বাজার এখন ডিজিটাল সেবার বাজারে পরিণত হবে, যা সেবার মান এবং দাম উভয় ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ডিজিটাল অর্থনীতির নতুন প্রাণকেন্দ্র
স্টারলিংকের আগমন বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিতে এক নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে। প্রফেসর ইউনূস সম্প্রতি দোহায় অনুষ্ঠিত আর্থনা সামিটে স্পেসএক্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট লরেন ড্রেয়ারের সঙ্গে আলোচনায় স্টারলিংকের পাশাপাশি পেপ্যাল (চধুচধষ)-এর মতো আন্তর্জাতিক পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মগুলোকে বাংলাদেশে আনার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
দেশের প্রায় ৮ লাখ ফ্রিল্যান্সার, যারা গ্রাফিক ডিজাইন, কন্টেন্ট রাইটিং, আইটি সার্ভিস ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের মতো খাতে কাজ করেন, তাদের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন হতে পারে। দ্রুত ও স্থিতিশীল ইন্টারনেট এবং আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সলিউশনের সমন্বয় তাদের বৈশ্বিক বাজারে আরও কার্যকরভাবে প্রতিযোগিতা করার পথ খুলে দেবে।
এ ছাড়া, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোও স্টারলিংকের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দারুণভাবে উপকৃত হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট ব্যবসাগুলো নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেস পেলে তারা ডিজিটাল অর্থনীতিতে আরও সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারবে। তারা সহজে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে, অর্ডার প্রক্রিয়া করতে এবং ইনভেন্টরি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। এটি কেবল বড় শহর নয়, বরং গ্রাম ও মফস্বল শহরগুলোকেও অর্থনীতির মূলধারায় যুক্ত করবে।
নিয়ন্ত্রণ ও আইনগত সংস্কার স্টারলিংকের অনুমোদনের পেছনে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সম্প্রতি জারি করা ‘লাইসেন্সিং গাইডলাইনস ফর নন-জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) স্যাটেলাইট সার্ভিসেস অপারেটর ইন বাংলাদেশ’ স্টারলিংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। স্টারলিংক সার্ভিসেস বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এই নতুন প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েছে, যা একটি যুগোপযোগী ও দ্রুতগতির সংস্কারের উদাহরণ। এই ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক পরিবর্তন ভবিষ্যতে আরও অনেক উদ্ভাবনী প্রযুক্তিকে বাংলাদেশে আসার পথ খুলে দেবে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ: সাশ্রয়ী মূল্য
স্টারলিংকের প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অসীম হলেও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর মূল্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশে স্টারলিংকের পরিষেবা তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল, যা বাংলাদেশের সাধারণ ব্যবহারকারীদের, বিশেষত গ্রামীণ বা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য নাগালের বাইরে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং স্টারলিংক যৌথভাবে একটি সাশ্রয়ী ট্যারিফ প্ল্যান তৈরির কাজ করছে। এখানে ভর্তুকি, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (চচচ) অথবা কমিউনিটি-ভিত্তিক অ্যাক্সেস মডেলের মতো কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে, যা খরচ কমাতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র এবং দুর্গম অঞ্চলের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির আওতায় বিনা মূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। ফাইজ আহমেদ তাইয়েব যেমনটা বলেছেন, স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কেবল সহজলভ্য হলেই হবে না, এটি সবার জন্য প্রবেশযোগ্য হওয়াও জরুরি। মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি যদি বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিচালনা করা হয়, তাহলে স্টারলিংক বাংলাদেশের ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশ
স্টারলিংকের লাইসেন্স প্রাপ্তি কেবল একটি প্রযুক্তিগত মাইলফলক নয়, এটি বাংলাদেশের জাতীয় অগ্রাধিকারে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, ডিজিটাল ক্ষমতায়ন এবং বৈশ্বিক সংযোগের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতিকে তুলে ধরে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ একটি শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে : বাংলাদেশ উদ্ভাবনের জন্য উন্মুক্ত, সমতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ডিজিটাল যুগে নেতৃত্ব দিতে বদ্ধপরিকর।
স্টারলিংকের স্যাটেলাইটগুলো যখন বাংলাদেশের আকাশে উচ্চ-গতির ইন্টারনেট সরবরাহ শুরু করবে, তখন সম্ভাবনার দ্বারগুলো উন্মোচিত হবে। এটি গ্রামীণ যুবকদের ক্ষমতায়ন করবে, ডিজিটাল বাণিজ্যকে নতুন জীবন দেবে এবং নিশ্চিত করবে যে দেশের কোনো সম্প্রদায়ই ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে না। বাংলাদেশের ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ এখন আর মাটিতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আকাশে ডানা মেলছে।
আপনার মতামত লিখুন :