গত ১২ জুলাই তারিখে ‘জীবনের গল্প বাকি আছে হয়তো’ শিরোনামের লেখাটি শেষ করে দিয়েছিলাম। পরে স্মৃতি হাতড়িয়ে দেখলাম, অনেক কথাই বলা হয়নি, গল্পের অনেক অধ্যায়ই বাকি রয়ে গেছে। যে অধ্যায় নিয়ে না বললে বাস্তবতা মুখ বুজে পড়ে থাকবে, অজানাকে জানা হবে না কখনো। তাই আবার গল্প বলা শুরু করতে হলো। শিরোনাম দিলাম ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ....’।
সান্ধ্য দৈনিক ‘সান্ধ্যবার্তা’য় যোগ দিলাম চুয়াত্তরে হয়তো। পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক মোতালেব তালুকদারের আন্তরিক অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। চলে এলাম র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের অফিসে। বিস্তৃত পরিসরের এক খালি স্পেসে লম্বাটে ধরনের ঘরে চলছিল সান্ধ্যবার্তার প্রকাশনা। সেখানেই পেলাম আলতাফ মাহমুদ এবং হাবিবুল্লাহ রানাকে। আলতাফ মাহমুদ ছেড়ে আসা ‘দৈনিক স্বদেশ’-এ আমার সহকর্মী ছিলেন। যার প্রসঙ্গ কমবেশি বলার চেষ্টা করেছি গত লেখার শুরুর দিকে। তাকে দেখে যারপরনাই আনন্দিত হলাম।
আনন্দের মাত্রা আরেক ধাপ বেড়ে গেল, যখন শুনলাম তিনিই বার্তা সম্পাদক। হাবিবল্লাহ রানার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। টগবগে তরুণ রানা বেশ প্রাণখোলা, দারুণ হাত। নানা শব্দ-প্রতিশব্দে পারদর্শী। রীতিমতো ফাটিয়ে দেওযার মতো রিপোর্ট করেন একেকটা। হাসি-তামাশায় গল্পোচ্ছলে মাতিয়ে রাখেন। মাঝে মাঝে নিজ কক্ষে বসে সম্পাদক মোতালেব ভাইও হো-হো করে অট্টহাসি দিয়ে ওঠেন। কাজের শুরুতেই পেশাগত দায়িত্বপালনকালে সান্ধ্যবার্তার টঙ্গিবাড়ি প্রতিনিধি রক্ষীবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হওয়ার মানবিক খবর আসে। সেই রিপোর্ট করার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। বেশ সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হলো আমাকে। কারণ, রক্ষীবাহিনী তখন এক আতঙ্কের নাম। বিষয়টি নিঃসন্দেহে স্পর্শকাতর। খোঁজ-খবর নিয়ে অনেক ভেবেচিন্তে রিপোর্টটি তৈরি করলাম।
শিরোনাম দেওয়া হলো ‘রক্ষীবাহিনীর এই ঔদ্ধত্যের জবাব কী’। তখনকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটে শিরোনামটি শক্ত হয়ে গেলেও বাস্তবতার নিরিখে এটিই ছিল যুতসই শিরোনাম। বলে রাখি, আমার বড় নির্ভয়ের জায়গা ছিল মোতালেব ভাই। কারণ তিনি তখন ছিলেন মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সমাজসেবা সম্পাদক এবং নামকরা নেতা এমপি পদপ্রার্থী কোরবান আলীর (যিনি পরবর্তীতে তথ্যমন্ত্রী হন) ডান হাত। পত্রিকা যেদিন বাজারে গেল, শুরু হয়ে গেল হুলুস্থুল। ফোনের পর ফোনে সরগরম অফিস-দৃঢ় চিত্তে মোতালেব ভাই সব ঝড় সামাল দিলেন অসম্ভব রকমের এক কৌশলী মনোভাবে।
আমার ভয় ছিল, রক্ষীবাহিনী না আবার আমার অফিস রেইড করে, আবার না আমাকে ধরে নিয়ে যায়। রক্ষীবাহিনীর তখন তেমনই ক্ষমতা। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের সম্মেলন ঘনিয়ে এলো। এ উপলক্ষে সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের ব্যবস্থা করা হলো। প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির আহ্বায়ক হলেন সেই ছাত্রনেতা, যার এক চিরকুটে সরকারি মালিকানাধীন ‘দৈনিক স্বদেশ’-এ আমার তাৎক্ষণিক চাকরি হয়েছিল। ক্রোড়পত্রের আবেদন নিয়ে মোতালেব ভাই আমাকেই পাঠালেন তার কাছে তিনি তখন র্যাঙ্কিন স্ট্রিট থেকে থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘পদক্ষেপে’-এ বসতেন। পত্রিকার কাজের ফাঁকে এক নজর তাকিয়ে বললেন, ‘বস’।
আমি ক্রোড়পত্রের আবেদনত্র এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘ভাই এটি আওয়ামী লীগের কাগজ’। তিনি এবার আবেদনপত্রের দিকে তাকিয়েই লাফ দিয়ে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘যে কাগজ রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে, সেই কাগজ আবার আওয়ামী লীগের হয় কীভাবে’। আমি নিরুত্তর। ক্ষোভ সামলে তিনি চেয়ারে বসে দীর্ঘশ^াস ফেলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। সুযোগ বুঝে আমি বলে ফেললাম, ‘ভাই সাপ্তাহিক পদক্ষেপের প্রতিনিধি যদি এভাবে নির্যাতিত হতেন, আপনি করতেন? আপনার তো লিখতে হতো না, আপনার ক্ষমতা আছে, আপনার এক টেলিফোনই যথেষ্ট। আমাদের তো তা নেই’।
বুঝলাম আমি কৌশলে জবর মার দিয়ে দিয়েছি। তিনি অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে ভাবলেন, এরপরই গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন ‘আচ্ছা, যা আমি সুপারিশ করব’। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল সান্ধ্যবার্তা ক্রোড়পত্রটি পেলই না। আমার রাগ হলো, খানিকটা অভিমানও হলো। আওয়ামী লীগের সম্মেলনের দিন একটি জ¦ালাময়ী লেখা লিখলাম। শিরোনাম দেওয়া হলো, ‘সোনার বাংলা আজ এমন দুঃখিনী সর্ব রিক্তা কেন’। বিট পিয়ন সম্মেলন স্থলে পত্রিকার কয়েক’শ কপি ছড়িয়ে দিল। মঞ্চে উপবিষ্ট নেতৃবৃন্দের হাতেও পৌঁছে গেল। শাহ মোয়াজ্জেম রাগত স্বরে বললেন, ‘কাগজটা কার, উল্টা-পাল্টা লিখছে’।
পারস্পরিক বৈরিতা থাকা সত্ত্বেও পাশ থেকে কোরবান আলী বলে উঠলেন, ‘ঠিকই আছে, আমরা কি অস্বীকার করতে পারব? তা ছাড়া এ পত্রিকা আমার ঘরের’। মুহূর্তেই সব আলোচনা থেমে গেল। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার পরিবর্তে স্বাভাবিক হয়ে এলো। পরদিন থেকেই অফিসে আমার সে কি কদর! আমার বেতন বেড়ে গেল, আমি হয়ে গেলাম সিনিয়র রিপোর্টার। একপর্যায়ে দৌড়ঝাঁপে আমি বড়ই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। শরীর বিশ্রাম চাইল। আমার প্রয়াত আব্বাজান জহিরুল হক ভূঁইয়া বনবিভাগে চাকরিসূত্রে তখন সুন্দরবনে, চঁদপাই রেঞ্জে কর্মরত। ভাবলাম সেখানেই বেড়াতে যাই। চলে গেলাম।
পরদিন নৌকা নিয়ে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়াই। অনুসন্ধিৎসু মন এক সময় আবিষ্কার করে, বনের সুন্দরী গাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে, মোটাতাজা হওয়ার বদলে কেমন যেন রুগণ হয়ে পড়ছে। লোকজনদের কাছে কারণ জানতে চাইলাম। বাওয়ালীরা জানাল পাহাড়ি খালগুলোর লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় গাছ ও পাতার এই রুগণ দশা। সেই সঙ্গে জানলাম সুন্দরবনের হরিণকুল চোরাই শিকারিদের নির্মম নিধনের শিকার হচ্ছে। হরিণের মাংস খুলনা শহরের আনাচে-কানাচে সুলভমূল্যে প্রকাশ্যে বিক্রির খবরও কথায় কথায় অবগত হলাম। বাসায় ফিরে এলাম, কিন্তু কাউকে কিছু বললাম না। সপ্তাহখানেক পর পিতা-মাতার সান্নিধ্য ছেড়ে ঢাকায় ফিরে এলাম।
পরদিন অফিসে গিয়ে এই অজানা কাহিনি লিখতে বসে গেলাম। নিমিষেই তৈরি হয়ে গেল বিশাল রিপোর্ট। একবারও বুঝতে পারিনি, এই রিপোর্ট আমার প্রয়াত পিতার চাকরিতে প্রভাব ফেলবে। কয়েকদিন পর হঠাৎ একদিন আমার পিতা নিজেই অফিসে এসে হাজির হলেন। ব্যাগসমেত তাকে দেখে বুঝলাম, তিনি বাসায় না গিয়ে সরাসরি অফিসে চলে এসেছেন। তিনি শোকজ নোটিশ দেখালেন। তাতে লেখা, ‘এই সাংবাদিক কীভাবে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলেন। জানতে পারলাম তিনি আপনার ছেলে। আপনাকে এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যাখ্যা দিতে বলা হলো’। তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।
তিনি যথারীতি জবাব দিলেন। কিন্তু জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে বন বিভাগের খুলনার বিভাগীয় কর্মকর্তা তাকে সাতক্ষীরা রেঞ্জে শাস্তিমূলক বদলি করে দেন। সাতক্ষীরা প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় পিতা অসম্ভব ভেঙে পড়েন। আমি কালবিলম্ব না করে প্রধান বন সংরক্ষকের মহাখালীর কার্যালয়ে ছুটে গেলাম। সব শুনে তিনি তাৎক্ষণিক টেলিগ্রাফ মারফত পিতাকে টাঙ্গাইলের হাঁটুভাঙ্গায় বদলি করে নিয়ে এলেন। মনে মনে ‘মহানকে’ ধন্যবাদ দিলাম আর ভাবলাম, এখানেই তো সাংবাদিকতা জীবনের সফলতা নিহিত।
.....চলবে
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক
রূপালী বাংলাদেশ
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন