ঢাকা শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৫

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের সংকট ও সম্ভাবনা

মো. হেলাল মিয়া
প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২৫, ০৬:৪৮ এএম

সম্প্রতি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িছে প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন যা সংক্ষেপে পিআর পদ্ধতি নামে পরিচিত। ইতোমধ্যে একটি জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশ ৭১% নাগরিক পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। প্রথমে ফ্রান্স ও ব্রিটেনে এই ধারণার উদ্ভব ঘটে। যখন দেখা যায়, পার্লামেন্টে ১৮৩০-এর দশকে ছোট রাজনৈতিক দল এবং সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হচ্ছে না তখন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে আধুনিক পিআর এর উদ্ভব ঘটে ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামে ১৮৯৯ সালে।

এরপর ইউরোপ মহাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। এটি ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি) এর বিকল্প নির্বাচন ব্যবস্থা হিসেবে ইসরায়েল, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডসহ বহু দেশে গৃহীত হয়। এমনকি এশিয়ার দেশ জাপান, শ্রীলঙ্কা, নেপালেও এর প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উন্নত দেশগুলো নিয়ে গঠিত সংগঠন ওসিডির ৩৬টি দেশের মধ্যে ২৫টি অর্থাৎ ৭০ শতাংশ দেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পিআর পদ্ধতির অনেকগুলো সুবিধা থাকলেও এর সংকটও কম নয়।

বহির্বিশ্বে সাধারণত তিন ধরনের পিআর পদ্ধতি দেখা যায়। তারমধ্যে একটি হলো মুক্ত তালিকা পদ্ধতি। যেখানে দলগুলো ভোটের ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে আসন পান। আরেকটি হলো বদ্ধ তালিকা পদ্ধতি। যেখানে সাধারণত দলগুলোর ঠিক করে দিয়ে থাকেন কে হবেন সংসদ সদস্য। এই দুটি পদ্ধতির বাহিরে আরেকটি পদ্ধতি হলো মিশ্র পদ্ধতি। মিশ্র পদ্ধতি কিছু আসনে প্রতীক ভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আবার কিছু আসনে পিআর এর ওপর ভিত্তি করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের ফলে দুর্বল সরকার গঠনের ঝুঁকি থাকে। এতে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো জোট গঠন করে সরকার গঠনের সুযোগ পান। ফলে সরকারের অভ্যন্তরে নানা মতের সৃষ্টি হয়। সে কারণে রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়। ফলে তাদের মধ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকে।

বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশের অন্তর্ভুক্ত। এদেশের জনগণ ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় সাক্ষরতার হার কম বিধায় তারা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। এমতাবস্থায় ভোট গণনা ও আসন বণ্টন সাধারণ মানুষের নিকট জটিল।

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ছোট দল ও আঞ্চলিক দলের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি উগ্রবাদী বিচ্ছিন্ন দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মধ্যে পড়তে পারে এবং রাজনৈতিক ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো সমস্যা জিইয়ে রেখে নি¤œকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে তুলনামূলক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি আরও বেশি অস্থিতিশীল হতে পারে। আবার যেহেতু দীর্ঘ বছর ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী এদেশ শাসন করেছে, সেহেতু পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাদের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী তাদের ভোটগুলো ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল বা মতকে সমর্থন যোগাবে।

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় প্রার্থী নির্বাচনের চাপ কমে গেলে জনগণের সঙ্গে সরাসরি দায়বদ্ধতা কমতে পারে। এতে জনগণের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কের অবনতির আশঙ্কাও রয়েছে। এতে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা হাজার কোটি টাকার মাধ্যমে হলেও কোনো না কোনো এলাকায় নির্বাচিত আসন ক্রয় করতে পারেন। ফলে তারা সংসদে এসে তাদের ব্যবসাবান্ধব আইন পাস করে ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার আরও বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে।

পিআর পদ্ধতির অনেকগুলো সংকটের মধ্যে অন্যতম আরেকটি সংকট হলো কোন দল কোন আসনে কোন ব্যক্তিকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেবেন তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হওয়ারও প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে জোট আলোচনা ও সরকার গঠনে বিলম্ব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার কোনো জাতীয় ইস্যুতে জোট ভেঙে যাওয়ারও প্রবণতা দেখা দেবে। এতে ঘনঘন সরকার পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তবে পিআর পদ্ধতির কিছু সংকট থাকা সত্ত্বেও বেশকিছু সুফল রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম একটি সুফল হলো- এতে ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। কারণ প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন হওয়ায় জনগণের ভোটের প্রতিফলন বেশি হয়। যা কেবলমাত্র পিআর পদ্ধতিতেই সম্ভব।

ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি) পদ্ধতিতে ভোট নষ্ট হয় বা অপচয় হয়। কারণ নির্দিষ্ট দলের প্রার্থী নির্দিষ্ট আসনে জয়ী না হলে সেই ভোটের কোনো প্রভাব থাকে না। ফলে সেই ভোটগুলো অপচয় হয়। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে এটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন করা হলে ছোট দল এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভোটও সংসদে প্রতিফলিত হয়। ফলে সব দল মতের অংশগ্রহণে কার্যকর সংসদ গড়ে ওঠে।

পিআর পদ্ধতির আরেকটি সুবিধা হলো- এতে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি পায়। ফলে বিভিন্ন মতাদর্শের পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সহজেই সংসদে প্রতিনিধিত্ব পায়। এতে করে বিশেষ এলাকায় বিশেষ কোনো ছাড় দিতে হয় না।

আবার পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে রাজনৈতিক সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়। কারণ এই পদ্ধতিতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে সরকার গঠন করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জোট গঠন করে সরকার গঠন করতে হয়। এ কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার মাধ্যমে কাজ করতে হয়।

ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (এফপিটিপি) পদ্ধতিতে ভোটের গুরুত্ব কম থাকায় ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতিও কম থাকে। বিশেষ করে বিগত ১৬ বছরে ভোট কেন্দ্রগুলোতে ভোটারের উপস্থিতি ছিল একেবারেই নগণ্য। তবে পিআর পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হলে ভোটারের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এখানে ভোটের গুরুত্ব পাওয়ায় ভোটের টার্ন আউট বেশি হতে পারে।

এত আলোচনা-সমালোচনার মাঝে বড় দলগুলো এফপিটিপি পদ্ধতিতে নির্বাচনকে সমর্থন করে। কারণ তারা এফপিটিপিতে কম ভোট পেয়েও আসন সংখ্যা বেশি পেয়ে থাকেন। এতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তারা সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবেন। ফলে চাইলেও ইচ্ছামতো আইন পাস করে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে পারবেন না।

আর ছোট দলগুলো পিআর পদ্ধতিকে সমর্থন করে। কারণ এই পদ্ধতিতে তাদের মতাবলম্বী মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়। এতে কম ভোট পেয়েও আসন পাওয়ায় জোট সরকারের মধ্যে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। ফলে সংসদে আইন পাস ও ভেটো প্রদানে তাদের গুরুত্ব অপরিসীম।

পিআর পদ্ধতি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তির একটি অন্যতম পথ। তবে এটি সব দেশে বাস্তবায়ন হওয়া অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ। কারণ একটি দেশের পার্শ্ববর্তীদেশ ও ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে রাজনীতি, অর্থনীতি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও অবকাঠামো নির্মাণ করা উচিত। তাহলে সবকিছুতে ব্যালেন্স থাকায় একটি দেশ দ্রুত এগিয়ে যায়। ধরুন একটি গবেষণাগারে কর্মরত সবাই চশমা পরে। কিন্তু সবার চশমার পাওয়ার কি একই? অবশ্যই না। ঠিক সেরকম সব দেশে এফপিটিপি আবার সব দেশে পিআর পদ্ধতিরও দরকার নেই। 

সুতরাং সবকিছুতে পশ্চিমা অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণও বোকামি। তবে সরকার যেহেতু জনগণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সুতরাং জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা ঠিক করা উচিত।

তবে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদে উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে অনেক সুফল পাওয়া যাবে। এতে করে উচ্চকক্ষে সব দলের প্রতিনিধি থাকায় ক্ষমতাসীন কোনো দল, কোনো কালো আইন পাস করলেও তা উচ্চকক্ষে বিরোধিতার কারণে সেই আইন পাস করা সম্ভব হবে না। তবে উভয় কক্ষে পিআর বা এফপিটিপি পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে শুধু পিআর কিংবা এফপিটিপি পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ না রেখে সংসদে ন্যায়পাল নিয়োগ দিতে হবে। এতে সাংসদদের জবাবদিহি বাড়বে ফলে দুর্নীতি, অর্থপাচারের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।

মো. হেলাল মিয়া
শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর