আমাদের জাতীয় জীবনে আগস্ট মাস এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ নানা ঘটনার সাক্ষী এ মাস। ২০২৪ সালের আগস্ট, আমাদের সামনে হাজির হয়েছে এক নতুন অধ্যায় নিয়ে। আমরা অর্জন করেছি, আরেকটি নতুন স্বাধীনতা, যা এসেছে ছাত্র, শ্রমিক, দিনমজুর ও দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষের হাত ধরে। এই স্বাধীনতার গায়ে লেগে আছে অসংখ্য মানুষের রক্ত, ত্যাগ ও বিসর্জনের ইতিহাস।
১৯৭১ সালে আমরা ৩০ লক্ষাধিক শহিদের জীবন এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। সেই আত্মত্যাগের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এবারের স্বাধীনতা, যা এসেছে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, তারও রয়েছে এক দীর্ঘ ত্যাগের ইতিহাস। শহিদ আবু সাঈদ, শহিদ মীর মুগ্ধ, শহিদ ফারহান ফাইয়াজ, শহিদ তাহমিদ এমন শত শত নাম আজ আমাদের নতুন করে চেনায় স্বাধীনতার মানে। তারা শুধু নাম নয়, তারা এক একটি পরিবার, এক একটি স্বপ্ন এবং দেশের জন্য উৎসর্গ করা এক একটি জীবন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তথ্যমতে, এই আন্দোলনে ১ হাজার ৫৮১ জন নিহত এবং ৩১ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, শুধু এ হাসপাতালেই ৭০০ বেশি মানুষ চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৬৬ জন এক চোখের এবং ১৭ জন দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। দেশের একটি দৈনিক জাতীয় পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৪১ জনের চোখ নষ্ট হয়েছে ছররা গুলিতে। তাদের মধ্যে ১৯ জন দুই চোখেরই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এ ছাড়া অসংখ্য মানুষ চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, কেউ হাত হারিয়েছেন, কেউ পা। এই পরিসংখ্যানগুলো শুধু সংখ্যা নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে লুকিয়ে আছে এক একটি গল্প ও করুণ কাহিনি।
এই নতুন স্বাধীনতার সূর্য উদয় হয়েছে সাজু ইসলামের মতো বাবার রক্তের বিনিময়ে, যার ৯ দিনের নবজাতক সন্তানের নাম রাখা হয়েছিল শহিদ আবু সাঈদের নামে। এই স্বাধীনতা এসেছে রিয়া গোপের মতো সাড়ে ছয় বছর বয়সি শিশুর জীবন দিয়ে, যে বাবার কোলে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢলে পড়েছিল। এই স্বাধীনতা এসেছে, সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মতো মানুষের আত্মত্যাগে, যিনি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। তার চার বছর বয়সি মেয়েটি আজ পিতৃহারা।
স্মরণ করি, দায় স্বীকার করি
শহিদ আবু সাঈদ, শহিদ মীর মুগ্ধ, শহিদ তাহমিদ, শহিদ ওয়াসিম কিছু নাম হয়তো আমরা পরিচিতি পেয়েছি, তাদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ভিডিও বা ছবি ভাইরাল হওয়ার কারণে। কিন্তু এমন শত শত নাম না, জানা মানুষ আছে, যাদের আত্মত্যাগ হয়তো আমাদের নজর কাড়তে পারেনি। তাদের জীবনের কি কোনো মূল্য নেই? গত বছর বেনাপোল এক্সপ্রেসের অগ্নিকা-ের ঘটনা আমাদের সবারই মনে থাকার কথা। এর মধ্য একজনের মৃত্যুর ভিডিও খুব অল্প সময়ের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। সেই ভিডিওর করুণ দৃশ্যটি এখনো আমাদের সবার হৃদয়ে নাড়া দেয়। যে ব্যক্তি সেখানে নির্মমভাবে মারা যায়, তার নাম আবু তালহা। তিনি সৈয়দপুর আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থী ছিলেন। বেনাপোল এক্সপ্রেসের আগুনের কথা মনে হলে সর্বপ্রথম সেই আবু তালহার কথাই আমাদের মনে পড়ে। কিন্তু বাকি আরও তিনজন নাতাশা জেসমিন, চন্দ্রিমা চৌধুরী সওমী ও এলিনা যে মারা গেল, তাদের কথা আমাদের মনে হয় না কেন? কারণ তাদের মৃত্যুর করুণ দৃশ্যটি ভাইরাল হয়নি, সে জন্য আমাদের নজরও কাড়তে পারেনি।
ঠিক একইভাবে, এবারের আন্দোলনে যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের সবার কথা কি আমরা মনে রাখছি? আমাদের এই নতুন স্বাধীনতা সাজু ইসলামের রক্তে কেনা, আমাদের ভাই আবু সাঈদের বুক পেতে পাওয়া, আমাদের ভাই ওয়াসিম আকরামের ঝরে যাওয়া রক্ত, আমাদের সাংবাদিক প্রিয়র আত্মত্যাগ আর ছোট বোন রিয়া গোপের ঘরে বসে হেলিকপ্টার থেকে খাওয়া গুলির বিনিময়ে পাওয়া।
৫২’র ভাষা শহিদ বা ৭১’র বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা কেবল কিছু দিবস এলে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি, স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিই। কিন্তু তাদের পরিবার বা উত্তরসূরিরা কেমন আছেন, তাদের খোঁজ কি আমরা রাখি? দুঃখজনক হলেও সত্যি, এ দায় আমরা কেউ নিই না, সরকারও নয়।
২০২৪-এর শহিদদের রক্তের সঙ্গে যেন এমন বিশ্বাসঘাতকতা না করা হয়। শুধু ফুল দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা নয়, তাদের পরিবারের পাশে থাকাটা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।
দায়িত্ব ও প্রত্যাশা
এই আন্দোলনের ফলে যারা দৃষ্টি হারিয়েছেন বা চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, তাদের দায় কে নেবে? হয়তো তারা কেউ ছিলেন দিনমজুর, কেউ রিকশাচালক, কেউ হকার বা সাধারণ শিক্ষার্থী। দেশের জন্য তাদের এ পরিণতি হয়েছে। শহিদ সাজুর ছেলে বা প্রিয়র মেয়ে আজ বাবা হারা। এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব তাদের খোঁজ রাখা, তাদের পাশে দাঁড়ানো।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা
১. বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের প্রত্যেক পরিবারের তালিকা তৈরি করে এককালীন প্রণোদনা এবং মাসিক সম্মানী ভাতা দিতে হবে।
২. যারা এই আন্দোলনে চোখ হারিয়েছেন বা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, তাদের প্রত্যেককে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ভবিষ্যতে যেন তাদের কারো কাছে হাত পাততে না হয়, তার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. এই আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর মর্ম তুলে ধরতে হবে।
আমরা যেন শুধু আগস্ট মাসের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকি। আমাদের স্মরণ করতে হবে, সেই সব বীরকে, যারা নতুন করে এই দেশকে স্বাধীন করেছেন। তাদের আত্মত্যাগ এবং পরিবারের প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধ যেন আমাদের কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। চে গুয়েভারার সেই অমর উক্তি আবারও মনে পড়ে, ‘বিপ্লবীদের মৃত্যু হয়, বিপ্লবের মৃত্যু হয় না।’ তাদের রক্তের বিনিময়ে যে বিপ্লব সাধিত হয়েছে, তা যেন আমাদের প্রজন্মের কাছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে।
ফাহিম হাসনাত
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন