জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। জনগণের ভোটাধিকার সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যোগ্য নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু যদি এই প্রক্রিয়ায় অপরাধে অভিযুক্ত, আদালতের ঘোষণায় ফেরারি কিংবা বিচার এড়িয়ে পালিয়ে থাকা ব্যক্তিরা প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পান, তবে নির্বাচনি ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং গণতান্ত্রিক চর্চা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মঙ্গলবার আদালত কর্তৃক ঘোষিত ফেরারি আসামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন এমন বিধান আইনে যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি); যা সময়োপযোগী উদ্যোগ। দীর্ঘদিন ধরে নাগরিক সমাজ ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো এ ধরনের বিধানের দাবি জানিয়ে আসছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও আগে থেকেই এ প্রস্তাব দিয়েছিল। যদিও ইসি শুরুতে দ্বিমত জানালেও পরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার পর তারা এই মতামত গ্রহণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে কার্যকর করতে পারলে গণতন্ত্র রক্ষায় ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
তবে কিছু শঙ্কা থেকেই যায়, এ ধরনের বিধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহার করা হতে পারে। কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে সাজানো মামলার মাধ্যমে তাকে ফেরারি দেখিয়ে নির্বাচনের বাইরে রাখার ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ জন্য প্রয়োজন কঠোর আইনি সংজ্ঞা ও সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া। আদালতের নিরপেক্ষ ঘোষণার ভিত্তিতেই কেবল ফেরারি আসামির মর্যাদা নির্ধারণ করতে হবে, যাতে প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ না থাকে।
এ ছাড়াও, ইসির প্রস্তাবে প্রার্থীকে সর্বশেষ ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল, দেশে-বিদেশে সম্পদের বিবরণ প্রকাশ এবং আয়ের উৎস জানানো বাধ্যতামূলক করার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জনস্বার্থে স্বচ্ছতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। অনলাইনের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটদানের সুযোগ তৈরি করা হলে গণতন্ত্র হবে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক।
এই প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকর আইনি কাঠামোর। নির্বাচন কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে এমন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি, যেখানে ফেরারি বা পলাতক আসামিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। পাশাপাশি মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের সময় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে থাকা মামলার অবস্থা যথাযথভাবে যাচাই করা উচিত। সেই সঙ্গে এটাও নজরে রাখতে হবে কোনো নিরপরাধ যেন প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার না হয়।
গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখতে হলে তার ভিত্তি শক্তিশালী করতে হবে। আর এ জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত, অপরাধী কিংবা ফেরারি আসামিদের নেতৃত্বের আসনে বসতে দেওয়া যাবে না। এটি শুধু জনগণের আস্থা ফেরাবে না, বরং নির্বাচনকে করবে আরও সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য।
আমরা আশা করব, সরকারের সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্ব নিয়ে ইসির এ প্রস্তাবগুলো দ্রুত আইনে রূপ দেবে সেই সঙ্গে যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।
আমরা মনে করি, ফেরারি আসামিদের ভোটে অযোগ্য রাখার বিধান যুক্ত হওয়া শুধু প্রয়োজনই নয়, সময়ের দাবিও বটে। গণতন্ত্রকে কলুষিত হতে দিতে না চাইলে এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাইলে এ উদ্যোগ কার্যকরের কোনো বিকল্প নেই।