ঢাকা শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সহযাত্রা

মো. শামীম মিয়া
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৫, ০৮:৩৯ এএম
অর্থনৈতিক অগ্রগতি

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্ধশতাব্দী ইতিহাস এক অনন্য রূপান্তরের সাক্ষী। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ধীরে ধীরে একটি উদ্ভাবনী, মানবসম্পদনির্ভর এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। দেশের আভ্যন্তরীণ উন্নয়ন, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, প্রযুক্তি এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এই অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এখনো পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়নিÑ নারী শ্রমশক্তি।

দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী শ্রমবাজারে তাদের পূর্ণ দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও নেতৃত্ব প্রদানের সুযোগ পাচ্ছেন না। তারা বৈষম্যের শিকার, কম মজুরি পান, নিরাপত্তার ঝুঁকির মুখোমুখি হন এবং উচ্চপদে নেতৃত্বে অংশ নিতে পারেন না। নারীর সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা কেবল সমতার বিষয় নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, বৈচিত্র্যময় উদ্ভাবন, এবং সামাজিক ন্যায়ের জন্য অপরিহার্য। 

নারী শ্রমশক্তির বর্তমান অবস্থাকে যদি সংক্ষিপ্তভাবে বিবেচনা করি, দেখা যায় তারা মূলত তৈরি পোশাকশিল্প, হোম-এন্ড হ্যান্ডিক্রাফট এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খাতে বড় ভূমিকা রাখছেন। লাখ লাখ নারী এই খাতে দারিদ্র্য হ্রাস এবং পরিবারের স্বাবলম্বিতা নিশ্চিত করেছেন। তবে এই শিল্পের বাইরে নারীর অংশগ্রহণ সীমিত। গ্রামীণ অঞ্চলে নারীরা প্রায়শই অবৈতনিক কৃষিকাজ, গৃহকর্ম এবং অপ্রচলিত ছোট উদ্যোগে নিযুক্ত থাকেন। এই অবদান সামাজিকভাবে স্বীকৃত হয় না। শহরের নারীরা পেশাদার চাকরিতে সীমিত সুযোগ, বৈষম্য এবং নিরাপত্তার কারণে পূর্ণ অংশগ্রহণ করতে পারেন না। মাতৃত্বকালীন সুবিধা, শিশু যতœ এবং নমনীয় কর্মপরিকল্পনার অভাবে অনেক নারী চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। শ্রমবাজারে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে দেশের উৎপাদনশীলতা, উদ্ভাবন এবং নেতৃত্বের ক্ষমতা দ্বিগুণ হবে।

শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের ভিত্তি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে উচ্চশিক্ষায় এখনো চ্যালেঞ্জ। ছোট বয়সে বিবাহ, আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা শিক্ষার ধারাবাহিকতা রোধ করে। শিক্ষিত নারী শ্রমবাজারে দক্ষ ও উদ্ভাবনী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তাদের উচ্চশিক্ষা, পেশাদার প্রশিক্ষণ এবং উদ্যোক্তা দক্ষতা দেশের মানবসম্পদকে শক্তিশালী করে।

নারী উদ্যোক্তা এবং কর্মী দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেন। তারা উদ্ভাবন, বাজারজাতকরণ এবং সামাজিক উদ্যোগে নতুন ধারণা নিয়ে আসেন। নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ প্রতিষ্ঠানে নীতি প্রণয়ন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমতার নিশ্চয়তা দেয়। বোর্ড এবং নীতি নির্ধারণে নারীর অংশগ্রহণ দেশীয় এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দেয়। উদ্যোক্তা নারী সমাজে রোল মডেল হয়ে ওঠেন। তাদের সফলতা অন্যান্য নারীদের অনুপ্রাণিত করে, যা একটি সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করে। যখন নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়, তখন পরিবার এবং সমাজে ন্যায়, সমতা এবং উদ্ভাবনী মানসিকতা বৃদ্ধি পায়।

নারীর অংশগ্রহণে প্রধান প্রতিবন্ধক হলো- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ও পরিবারিক প্রত্যাশা অনেক নারীকে চাকরি গ্রহণ থেকে বিরত রাখে। নিরাপত্তার উদ্বেগ, বিশেষ করে যাতায়াত এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, নারীর চলাচল সীমিত করে। এই ধরনের বাধা শুধু নারীর ব্যক্তিগত সম্ভাবনাকে ক্ষুুণœ করে না, দেশের উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবনকেও সীমিত করে।

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো, পেশাগত প্রশিক্ষণ এবং উদ্যোক্তা দক্ষতা বৃদ্ধি। কর্মক্ষেত্রে সমতা: সমান মজুরি, পদোন্নতি, নিরাপত্তা এবং বৈষম্য নিরোধক ব্যবস্থা। মাতৃত্বকালীন সুবিধা: শিশু যতœ, নমনীয় কর্মপরিকল্পনা এবং পারিবারিক সমর্থন। উদ্যোক্তা ও নেতৃত্বে অংশগ্রহণ: বোর্ড, নীতি নির্ধারণ ও ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। সাংস্কৃতিক সচেতনতা ও পরিবর্তন: পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়নের সামাজিক স্বীকৃতি।

বাংলাদেশে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে ইসলাম নারীর অর্থনৈতিক কর্মকা- সীমিত করে। বাস্তবে, ইসলাম নারীকে সম্পত্তি, ব্যবসা এবং চাকরির অধিকার দেয়। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর স্ত্রী খাদিজা (রা.) ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। কোরআন স্পষ্টভাবে নারীর উপার্জন এবং সম্পত্তিতে অধিকার নিশ্চিত করে। নারীর সীমিত অংশগ্রহণের মূল কারণ সামাজিক ও পিতৃতান্ত্রিক ধারণা, ধর্ম নয়। এটি সংস্কার, নীতি এবং সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো প্রমাণ করেছে, নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ দেশকে সমৃদ্ধ ও টেকসই করতে পারে। সুইডেন, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ডে উচ্চ নারী শ্রম অংশগ্রহণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। পশ্চিম ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীর শিক্ষা, উদ্যোক্তা ও নেতৃত্বে অংশগ্রহণ উদ্ভাবন, প্রতিযোগিতা এবং সামাজিক উন্নয়ন বাড়িয়েছে। জাপান ‘ওমেনমিকস’ নীতি গ্রহণ করে নারী শ্রমশক্তি কাজে লাগিয়ে দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করছে। বাংলাদেশের জন্য এই ধরনের নীতি গ্রহণ করলে নারীর ক্ষমতায়ন আরও সহজ হবে এবং দেশের অর্থনীতি দ্রুত প্রসারিত হবে।

নারী উপার্জন করলে পরিবারে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি নিশ্চিত হয়। শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ উন্নত হয়। নারীরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রোল মডেল হিসেবে কাজ করেন, যা পরবর্তী প্রজন্মকে সমানাধিকার, উদ্ভাবনী মনোভাব এবং নেতৃত্ব বিকাশে প্রভাবিত করে। নারীর ক্ষমতায়ন দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি।

নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বাংলাদেশকে একটি টেকসই, উদ্ভাবনী ও ন্যায়সংগত জাতিতে রূপান্তরিত করতে পারে। সরকার, এনজিও, করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের সব স্তরকে একযোগে কাজ করতে হবে। শিক্ষার উন্নয়ন, কর্মক্ষেত্রে সমতা, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, উদ্যোক্তা ও নেতৃত্বের সুযোগ, এবং সাংস্কৃতিক সচেতনতা বৃদ্ধিই দেশের টেকসই উন্নয়নের চাবিকাঠি। নারীর সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশ কখনোই ২০৪১ সালের উচ্চ-আয় ভিত্তিক দেশ হওয়ার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না।

নারী শ্রমশক্তি, উদ্যোক্তা এবং নেতৃত্বে সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলে আমরা একটি সমৃদ্ধ, ন্যায়সংগত, উদ্ভাবনী এবং টেকসই বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হব। নারীর ক্ষমতায়ন কেবল আজকের সমস্যা নয়; এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের উন্নয়ন, অর্থনীতি এবং সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তি। এটি নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রয়োজনও। সময় এসেছে, আমাদের নীতি, পরিকল্পনা এবং সামাজিক মানসিকতাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে নারীরা পূর্ণ সম্ভাবনা অনুযায়ী অংশগ্রহণ করতে পারে। নারী শক্তি কাজে লাগালে আমরা একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারব।

মো. শামীম মিয়া, কলামিস্ট