সম্প্রতি দেশে মব সহিংসতার প্রবণতা যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তা শুধু উদ্বেগজনক নয়, সামাজিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের জন্য মারাত্মক হুমকিও বটে। নওগাঁ সরকারি কলেজে ছাত্রনেতার ওপর হামলা থেকে শুরু করে টাঙ্গাইলে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বাড়িতে মুখোশধারীদের আক্রমণ কিংবা রাজবাড়ীতে লাশ তুলে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা প্রমাণ করছে, সাধারণ মানুষের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীন হয়ে পড়ছে। সহিংস জনতা এখন আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের হাতে বিচার করছে। এ ধরনের নৃশংসতা সভ্য সমাজে অকল্পনীয়।
পরিসংখ্যান বলছে, কেবল গত এক বছরে অন্তত ২২০ জন মব সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে শিক্ষক, পুলিশ, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অভিযুক্ত চোর-ডাকাতও রয়েছেন। এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া শুধু একজন ব্যক্তির জীবনকেই হুমকির মুখে ফেলছে না, বরং পুরো সমাজে ভয়, অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলার প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করছে। আরও উদ্বেগজনক হলো, অনেক সময় ‘তৌহিদি জনতা’ কিংবা বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচয়ের আড়ালে সংগঠিত গোষ্ঠীগুলো এই সহিংসতার নেতৃত্ব দিচ্ছে, যা প্রকৃতপক্ষে উচ্ছৃঙ্খলতা ও অসহিষ্ণুতার নগ্ন বহির্প্রকাশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়া এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিলতা এ সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে। আবার কিছু গোষ্ঠী মবকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নিজেরা অসৎ স্বার্থ হাসিল করছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস, প্রতিপক্ষকে চাকরি থেকে অপসারণ কিংবা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করা এর দৃষ্টান্ত। ফলে মব সহিংসতা কেবল আইনশৃঙ্খলা নয়, সামগ্রিক সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ংকর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো স্পষ্ট বলছে, মব সহিংসতা কোনোভাবেই আইনি কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; এটি মৌলিক অধিকার ও মানব মর্যাদার চরম লঙ্ঘন। মৃতদেহ কবর থেকে তুলে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ভয়াবহ ঘটনা আমাদের নৈতিক অবক্ষয়েরও জ্বলন্ত প্রমাণ। এভাবে যদি রাষ্ট্র কঠোর অবস্থান না নেয়, তবে আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
এ ধরনের ঘটনার পেছনে যেমন আইনের শাসনের দুর্বলতা দায়ী, তেমনি দায়ী হচ্ছে জনমনে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্রুত পদক্ষেপের অভাব, তদন্তের ধীরগতি ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় জনগণের ভেতর এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে। সেই হতাশা থেকেই অনেক সময় মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, যার ফলাফল হচ্ছে ভয়াবহ।
আমরা মনে করি, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দরকার কঠোর আইনি ব্যবস্থা। মব সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। জনসাধারণকে বোঝাতে হবে যে মব একটি গুরুতর অপরাধ এবং তার পরিণতি আইনত শাস্তিযোগ্য। সামাজিক ও ধর্মীয় নেতাদের এগিয়ে আসতে হবে সহিংসতা প্রতিরোধে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আইন হাতে তুলে নিলে সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় না, বরং অন্যায় আরও গভীর হয়। একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও সচেতন সমাজ গঠনের স্বার্থেই আমাদের সবাইকে মব সহিংসতার বিরুদ্ধে একসঙ্গে সোচ্চার হতে হবে।
আমরা আশা করব, সরকার দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে মব সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে এটি চিরতরে বন্ধ করবে। প্রতিটি ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুততম সময়ে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনবে। কেননা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্র, মব বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সচেতন নাগরিক সমাজকে একযোগে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে এই সহিংসতার আগুন ছড়িয়ে পড়তেই থাকবে সর্বত্র, আর তার পরিণতি হবে আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ।