অন্তর্বর্তী সরকারের প্রকাশিত সম্প্রতি প্রতিবেদনে যে অপরাধের চিত্র ফুটে উঠেছে, তা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। চলতি বছরের আট মাসে ২ হাজার ৬১৬টি খুন এবং ১৫ হাজার ৪৯টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২০-২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত অপরাধের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তুলনামূলক এ সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
প্রেস উইংয়ের প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শেষ ১৩ মাসে খুনের হার বেশি বলে মনে হলেও এর আংশিক কারণ হলো শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে সংঘটিত কমপক্ষে ১ হাজার ১৩০টি খুনের ঘটনায় গণঅভ্যুত্থানের পরে অর্থাৎ, ৬ আগস্ট, ২০২৪ সালের পর থেকে এ বছরের আগস্টের মধ্যে মামলা হয়েছে। অনেক হত্যা মামলা পূর্বে ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে দায়ের করা যায়নি, পুলিশকেও মামলা নিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের পরেই এসব তথ্য সামনে এসেছে এবং মামলাগুলো রেকর্ড করা হয়েছে।
একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে, বেশকিছু অপরাধের হার যেমন, চুরি, দাঙ্গা এবং দ্রুত বিচার আইনের আওতাভুক্ত অপরাধ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০২৪ সালে যেখানে চুরির ঘটনা ছিল ৮ হাজার ৬৫২, সেখানে ২০২৫ সালে হয়েছে ৬ হাজার ৩৫৪। দাঙ্গার ঘটনাও অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ থেকে বোঝা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন রাজনৈতিক চাপমুক্ত হয়ে কাজ করছে এবং জনগণও অভিযোগ জানানোর পরিবেশ পাচ্ছে।
তবুও যে চিত্র ভয় ধরায় তা হলো, নারী ও শিশু নির্যাতনের অস্বাভাবিক উচ্চহার। সমাজে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে আইনশৃঙ্খলার উন্নতির দাবিটি অর্থহীন হয়ে পড়ে। খুন, নারী ও শিশু নির্যাতন কিংবা ডাকাতির মতো সহিংস অপরাধ প্রতিরোধে কেবল মামলা রেকর্ড করাই যথেষ্ট নয়, বরং কঠোর তদন্ত, দ্রুত বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করাই জরুরি।
অতএব, সরকারের উচিত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অপরাধী যেই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। ভুক্তভোগীদের আস্থা ধরে রাখতে হবে এবং একইসঙ্গে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু মামলা নথিভুক্ত হওয়া নয়, অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই অপরাধ কমে আসবে।
নিরাপত্তা বাহিনীর আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অপরাধ দমনে যেসব ঘাটতি দৃশ্যমান, সেগুলোর প্রতি কর্তৃপক্ষের মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরও যথাযথ তদন্ত হয় না, কিংবা দোষীরা শাস্তির বাইরে থেকে যায়। এতে অপরাধীদের মনোবল বাড়ে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিচারহীনতার সংস্কার গড়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আমরা মনে করি, প্রয়োজনীয়ভাবে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো, জনগণের তথ্য সহায়তা নেওয়া এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে।
আমরা আশা করব, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবার আগে নিরাপদ সমাজব্যবস্থা প্রণয়নে গুরুত্ব দেবে সরকার। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন না ঘটলে দেশের সার্বিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে এই বিষয়টির দিকেও নজর দিতে হবে। কেননা রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব নাগরিকদের জীবন ও নিরাপত্তা রক্ষা। তাই সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোরভাবে এই বার্তাই দিতে হবে, অপরাধ করলে কেউই রেহাই পাবে না।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন