বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, তদন্তে গাফিলতি, মিথ্যা সাক্ষ্য ও আইনি প্রক্রিয়ায় অসঙ্গতির কারণে ভয়াবহ অপরাধের বিচার ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। সম্প্রতি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য আমাদের বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা ও বিচারের অকার্যকারিতা নগ্নভাবে উন্মোচন করেছে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে রায় হওয়া ২৩৮টি হত্যা মামলার মধ্যে ১২৩টি মামলায় আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছে, অর্থাৎ শতকরা প্রায় ৫২ ভাগ। খালাসপ্রাপ্তির পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে সাক্ষীর অনুপস্থিতি, তদন্তে ত্রুটি, ময়নাতদন্ত ও ম্যাজিস্ট্রেটের ভুল, এবং বাদী-বিবাদীর আপস। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক দিক হলো, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন আসামিরাও খালাস পেয়েছে, যেখানে বাদী ও প্রসিকিউশন সক্রিয় ছিল। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সুকৌশলে আইনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে গেছে এসব ভয়ংকর আসামি।
প্রতিবেদনে স্পষ্ট, বৈরী সাক্ষীর কারণে ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ, তদন্তে ত্রুটির কারণে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং এ দুইটির সমন্বয়ে ২৬ শতাংশ মামলায় খালাস হয়েছে। এসব তথ্য কেবল পরিসংখ্যান নয়, বরং বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হারানোর করুণ প্রতিফলন।
অন্যদিকে মামলাগুলোর বিচারে গড়ে সময় লেগেছে ১০ বছর ১১ মাস, তদন্তেই লেগেছে গড়ে ১ বছর ৬ মাস। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া এবং তদন্ত কর্মকর্তার বদলি, সাক্ষীর আগ্রহ হারানো, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের গাফিলতি, এমন নানা বাস্তবতাই একটি হত্যা মামলাকে ধীরে ধীরে অর্থহীন করে তুলেছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো ফৌজদারি মামলায় আসামি খালাস পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু কারণ থাকে। মামলার অভিযোগকারী পক্ষ পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না দেওয়ায় আসামিরা খালাস পেয়ে থাকেন। অনেক সময় সাক্ষীরাও উপস্থিত থাকেন না। এ ছাড়াও আপস-মীমাংসার ভিত্তিতেও আসামিদের খালাস করে দেওয়া হয়। তবে এসব ছাড়াও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা একটা বড় অন্তরায়। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যান আসামিরা।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, খুনের মতো গুরুতর অপরাধের মামলায়ও সমঝোতার আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। যদিও আইনি দৃষ্টিকোণে খুনের মামলায় আপসের কোনো সুযোগ নেই, তথাপি সাক্ষ্য না দেওয়া বা সাক্ষ্য ঘুরিয়ে দিয়ে আসামিকে খালাস করার উদাহরণ বাড়ছে। এটি বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহার এবং আইনের শাসনের জন্য এক ভয়ংকর বার্তা।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। প্রথমত, খুনসহ গুরুতর অপরাধের মামলায় তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, তদন্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে, বিশেষত যেখানে তাদের গাফিলতির কারণে খালাসের সম্ভাবনা থাকে। তৃতীয়ত, সাক্ষী সুরক্ষা আইনের বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা ভয়ভীতি বা প্রলোভনের প্রভাবিত না হয়।
এ ছাড়াও, বিচার প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল নজরদারি ও তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে সাক্ষী ও তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য ভবিষ্যতে প্রত্যয়নের জন্য ব্যবহার করা যায়। ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণ ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করাও অপরিহার্য, যেন তারা ভুলবশত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপেক্ষা না করেন।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বিচার বিভাগের কার্যকারিতা যদি বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ে, তবে রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর তার ভয়াবহ প্রভাব পড়ে। মানুষের মনে যদি এই বিশ্বাস জন্ম নেয় যে, খুন করেও ছাড়া পাওয়া সম্ভব, তবে সমাজে ন্যায়বিচারের শেষ আশাটুকুও নিঃশেষ হয়ে যাবে।
আমরা আশা করব, সরকার দ্রুত আইনের শাসন পুনরুদ্ধারে কঠোর ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেবে। হত্যা মামলার আসামিরা যেন কোনোভাবেই আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে সেই লক্ষ্যে রাষ্ট্র ও আদালতকে একযোগে কাজ করবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষ আইনের প্রতি আস্থা হারাবে।