ঢাকা রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় সংস্কার আনা হোক

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৫, ১২:৪৩ এএম

সরকারি ব্যয়ের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রগুলোর একটি হলো ক্রয় কার্যক্রম। এ খাতের প্রতিটি ধাপই দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নবিদ্ধ। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কোটাবাজি, সিন্ডিকেটের প্রভাব ও স্বচ্ছতার অভাবে একে বহুবার ‘সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি কিংবা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পর্যন্ত স্পষ্ট করে বলেছে, এ খাতে অনিয়মের কারণে সরকারি অর্থের বিপুল অপচয় হয়। ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সরকারি ক্রয়ে ৩০ শতাংশ ব্যয় অস্বচ্ছতার কারণে অপচয় হয়।

এ প্রেক্ষাপটে সরকার এখন উদ্যোগ নিয়েছে, বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এমনকি যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানির বড় কেনাকাটাও কেন্দ্রীয় ক্রয় কমিটির অনুমোদনের আওতায় আনার। সরকারের এ প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। বিদ্যুৎ, জ্বালানি কিংবা শিল্প খাতের মতো জায়গায় অস্বচ্ছ ব্যয় রোধে কেন্দ্রীয় নজরদারি জরুরি। 

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সরকারের এ পদক্ষেপ ইতিবাচক হলেও বাস্তবায়নে নতুন জটিলতা তৈরি হতে পারে। সরকারি যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চাইলে তাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় অনুমোদনের বেড়াজালে তারা যদি জড়িয়ে পড়ে, তবে ব্যাবসায়িক গতি কমে যেতে পারে।

এ ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক জটিলতার বিষয় উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। প্রথমত, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালা পরিবর্তন ছাড়া সরকারের উদ্যোগ কার্যকর হবে না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এরই মধ্যেই স্পষ্ট করেছে, এই আইনি সংশোধন না হলে প্রস্তাব অনুমোদনের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে না। ফলে প্রথম কাজ হওয়া উচিত আইনগত সংস্কার নিশ্চিত করা।  

দ্বিতীয়ত, যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানির ব্যাবসায়িক স্বায়ত্তশাসন সীমিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেমন, ইউনিলিভার বাংলাদেশ বা কোকা-কোলার মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে সরকারের শেয়ার থাকলেও তাদের প্রতিটি বড় কেনাকাটায় ক্রয় কমিটির অনুমোদন চাইলে ব্যাবসায়িক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে।

তৃতীয়ত, শুধু আইন সংশোধন করলেই হবে না, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে হতে হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক। অন্যথায় পুরোনো সমস্যা থেকে যাবে। অভিজ্ঞতা বলছে, সরকারি ক্রয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকলেও যদি তা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কব্জায় চলে যায়, তবে নতুন আইনের ফলও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

আমরা আশা করছি, সরকার এ তিনটি দিক গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় এনে সামনে আগাবে। পিপিএ ২০০৬ ও সংশ্লিষ্ট বিধিমালা জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা, যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানির ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা তৈরি করা, এতে নজরদারি যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি তাদের ব্যাবসায়িক গতিশীলতাও বজায় থাকবে এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত রাখা। তবেই সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া বা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট একটি দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করবে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সরকারি ক্রয় শুধু একটি প্রক্রিয়া নয়, এটি জনস্বার্থ সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশে বার্ষিক বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই ব্যয় হয় বিভিন্ন পণ্য, সেবা ও অবকাঠামো নির্মাণে। অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ একযোগে প্রয়োজন।

দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যেন সময়মতো, মানসম্পন্ন এবং সাশ্রয়ীভাবে বাস্তবায়িত হয়, তা নিশ্চিত করতে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় একটি ব্যাপক, কার্যকর ও সময়োপযোগী সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।