বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসর আজ এক গভীর সংকটের মুখোমুখি। ক্ষমতার দখল, মনোনয়ন কেন্দ্রিক রাজনীতি, নেতৃত্বের বিচ্ছিন্নতা এবং জনগণের অসহায়ত্ব একত্রিত হয়ে একটি জটিল ও দ্বন্দ্বপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। রাজনৈতিক দলের প্রতিটি আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর উপস্থিতি অভ্যন্তরীণ বিভাজন তীব্র করে। এই বিভাজন শুধু দলের নেতাদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করে না, বরং সাধারণ জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগও দুর্বল করে। ভোটাররা তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নেতাদের প্রত্যাশা করে, কিন্তু তারা লক্ষ্য করে যে নেতারা কেবল কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অন্দরমহলে মনোনয়ন নিশ্চিত করার জন্য ব্যস্ত, জনগণের পাশে থাকার সময় নেই। এর ফলে নির্বাচনি অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিএনপি এই সংকটের সবচেয়ে প্রকট উদাহরণ। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার ফলে দলটির অভ্যন্তরীণ কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। নেতৃত্বের স্থবিরতা, সাংগঠনিক দুর্বলতা, এবং মনোনয়নপ্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতা একত্রে দলটিকে জনমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ করেছে। প্রতিটি আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর উপস্থিতি প্রকৃত জনপ্রিয় নেতাদের প্রান্তিক করে দিয়েছে। যারা মাঠে থেকে সংগ্রাম করেছে এবং সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, তারা প্রায়শই মনোনয়ন পায় না।
বরং সুযোগ পায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ বা আর্থিকভাবে প্রভাবশালী প্রার্থীরা। এই পরিস্থিতি তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে এবং ভোটারদের আস্থা ক্ষুণœ করেছে। বিভাজন এবং বিচ্ছিন্নতা শুধু মনোনয়ন-প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি দলের সাংগঠনিক কাঠামো, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং জনমুখী নীতি প্রণয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রতিঅঙ্গ দ্বন্দ্ব ভোটারদের কাছে নেতাদের প্রভাবশালী বা গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসাবে দৃশ্যমান হতে বাধা দেয়। এর ফলে রাজনৈতিক কর্মকা-ে জনগণের অংশগ্রহণ হ্রাস পাচ্ছে এবং দলের স্থায়িত্ব ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
জামায়াত ইসলামী অন্যরকম প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। সাংগঠনিকভাবে তারা তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী ও শৃঙ্খলাবদ্ধ। তাদের মনোনয়ন-প্রক্রিয়া প্রাতিষ্ঠানিক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর কর্মীরা তা মেনে চলে। ফলে অভ্যন্তরীণ বিভাজন প্রকাশ্যে আসে না, এবং জনগণের চোখে দলটি একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতীয়মান হয়। মানুষের মনস্তত্ত্বে শৃঙ্খলাবদ্ধতার গুরুত্ব অপরিসীম; তারা বিশৃঙ্খলাপূর্ণ দলকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না।
মনোনয়ন কেন্দ্রিক রাজনীতি জনগণকে অসহায় করে তুলছে। নেতারা ভোটারদের কাছে কম আসে, তারা কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অন্দরমহলে ব্যস্ত থাকে। এই বিচ্ছিন্নতা জনগণের আস্থা হ্রাস করছে এবং নির্বাচনি অংশগ্রহণ কমাচ্ছে। বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় এই বিচ্ছিন্নতা তাদের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর। সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং নেতৃত্বের স্থবিরতা দলকে জনমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ করেছে।
পুরোনো রাজনৈতিক কৌশল যেমন- নেতার জনপ্রিয়তা, সমাবেশ, বা দান-দক্ষতা, বর্তমান প্রযুক্তি এবং সামাজিক বাস্তবতায় কার্যকর হচ্ছে না। তথ্যপ্রযুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে। তারা এখন কেবল বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয় না; তারা কাজ, প্রতিশ্রুতি, এবং ফলাফল দেখতে চায়। পুরোনো কৌশল অনুসরণ করলে দলগুলো জনমুখী হতে পারবে না এবং নির্বাচনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বড় রাজনৈতিক দলের জন্য সমাধান অত্যাবশ্যক। মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা সীমিত করতে হবে, জনগণের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ রাখতে হবে, দলীয় ভেতরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে হবে, এবং অর্থ বা প্রভাবের ভিত্তিতে নির্বাচনি প্রক্রিয়া প্রভাবিত হতে দেওয়া যাবে না। শুধু তখনই জনগণ নেতাদের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করবে, এবং দলগুলো দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকবে।
জনগণের মনস্তাত্ত্বিক প্রত্যাশাও স্পষ্ট। তারা চায় নেতারা জনগণের পাশে থাকুক, তাদের সমস্যার সমাধানে সক্রিয় হোক, এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা বজায় রাখুক। বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ও দ্বন্দ্বপূর্ণ দলকে মানুষ গ্রহণ করে না। জামায়াত ইসলামী সাংগঠনিক শৃঙ্খলার কারণে বিশ্বাসযোগ্য। বিএনপির জন্য বর্তমান পরিস্থিতি জরুরি, কারণ তারা ইতোমধ্যেই জনগণের আস্থা হারিয়েছে। যদি সাংগঠনিক সংস্কার, নেতৃত্ব পুনর্গঠন এবং জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন না করে, তবে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে তাদের অস্তিত্ব সংকুচিত হবে।
নেতৃত্বের বিচ্ছিন্নতা কেবল বিএনপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমগ্র রাজনৈতিক পরিসরের একটি চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনি প্রক্রিয়ার সময় মনোনয়নপ্রত্যাশীর ভিড় ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় দলের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রতিঅঙ্গ দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছে। সাধারণ জনগণ নেতাদের কাছে তাদের সমস্যা, প্রত্যাশা বা প্রশ্ন নিয়ে যেতে চাইলেও তারা সচরাচর সুযোগ পায় না। কারণ নেতা তাদের সময় ভাগ করছেন কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক অন্দরমহলে। এর ফলে জনতার সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ দুর্বল হয় এবং দলীয় কার্যক্রম জনমুখী হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে মনোনয়ন-প্রক্রিয়ার বিশৃঙ্খলা কার্যকারিতা হ্রাস করছে। যখন এক আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকে, তখন দলীয় নেতৃত্বকে এমন পরিস্থিতিতে সমাধান করতে হয়, যেখানে প্রার্থীদের মধ্যে স্বচ্ছ ও ন্যায্য নির্বাচন প্রক্রিয়া বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। একদিকে জনপ্রিয় নেতা বা তৃণমূল কর্মীরা মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে যারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ বা আর্থিকভাবে শক্তিশালী, তারা সুযোগ পায়। এই পরিস্থিতি কর্মীদের মধ্যে বিভাজন ও হতাশা সৃষ্টি করে, যার প্রভাব ভোটারদের মনোভাবেও প্রতিফলিত হয়।
জনগণ তখন নেতাদের রাজনৈতিক কর্মকা-ে সান্নিধ্য অনুভব করতে পারে না। তারা চায় নেতা যেন তাদের পাশে থাকে, সমস্যা সমাধানে সক্রিয় হোক, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করুক। কিন্তু মনোনয়ন-প্রক্রিয়ার কারণে নেতা জনগণের কাছ থেকে দূরে থাকে, ফলশ্রুতিতে ভোটারদের আস্থা হ্রাস পায়। বিএনপির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতার বাইরে থাকা এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজন এই সমস্যাকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগের বিস্তার জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে। তারা কেবল বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয় না; তারা নেতাদের বাস্তব কর্মকা-, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন, এবং ফলাফল দেখতে চায়। পুরোনো কৌশল অবলম্বন করলে দলগুলো জনমুখী হতে পারবে না এবং নির্বাচনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই বড় দলগুলোকে অবশ্যই নতুন কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
মনোনয়ন-প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, জনগণের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শক্তিশালীকরণ, এবং অর্থ বা প্রভাবের ভিত্তিতে নির্বাচনি প্রক্রিয়া প্রভাবিত না হওয়াÑ এই পদক্ষেপগুলো অপরিহার্য। শুধু তখনই জনগণ নেতাদের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করবে এবং দলগুলো দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকবে।
নেতৃত্বের বিচ্ছিন্নতা জনগণের আস্থাকে প্রভাবিত করছে। তারা চায় নেতা যেন সমস্যার সমাধানে সক্রিয় হোক, তাদের পাশে দাঁড়াক, এবং নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখুক। বিশৃঙ্খলাপূর্ণ এবং দ্বন্দ্বপূর্ণ দল জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। জামায়াতের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা তাদের একটি বিশ্বাসযোগ্য দল হিসেবে উপস্থাপন করছে। বিএনপির জন্য এটি জরুরি, কারণ তারা ইতোমধ্যেই জনগণের আস্থা হারিয়েছে।
মানববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, জনগণ রাজনীতিকে কেবল ক্ষমতার লড়াই হিসেবে দেখতে চায় না; তারা চায় নেতৃত্বের সঙ্গে সংযোগ, স্বচ্ছতা, এবং সামাজিক ন্যায্যতা। রাজনৈতিক দলগুলোকে এই চাহিদা পূরণ করতে হবে। বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলো যদি পুরোনো কৌশল অবলম্বন করে চলতে থাকে, তবে জনগণের আস্থা আরও ক্ষুণœ হবে, এবং রাজনীতি কেবল নেতাদের ব্যক্তিস্বার্থের লড়াইয়ে পরিণত হবে।
রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকা সম্ভব নয়। মনোনয়ন-প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, নেতৃত্বের জনগণের সঙ্গে সংযোগ, এবং গণতান্ত্রিক চর্চা ছাড়া কোনো দল রাজনৈতিক শক্তি ধরে রাখতে পারবে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমশ একটি ক্রান্তিকালের মুখোমুখি। মনোনয়ন কেন্দ্রিক রাজনীতি, নেতৃত্বের বিচ্ছিন্নতা, এবং জনগণের অসহায়তা একত্রে একটি সংকটের চিত্র তৈরি করছে।
অতএব, রাজনৈতিক দলগুলোকে এখনই প্রয়োজন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ। তাদের কৌশল অবশ্যই প্রতিশ্রুতিশীল, জনগণমুখী, এবং স্বচ্ছ হতে হবে। রাজনৈতিক নেতা জনগণের কাছে ফিরে আসতে হবে, নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, এবং সাংগঠনিক সংস্কার করতে হবে। জনগণ রাজনীতির মূল শক্তি, এবং তাদের আস্থা ছাড়া কোনো দল দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকতে পারবে না।
পরিশেষে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব এবং জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য প্রয়োজন: নেতৃত্বের জনগণের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ, মনোনয়ন-প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, সাংগঠনিক সংস্কার, এবং গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতিশ্রুতি। এই সংস্কার ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো কেবল স্বার্থপর ক্ষমতার লড়াইয়ে নিযুক্ত থাকবে এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। জনতার আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামো গঠন ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতি স্থিতিশীল হবে না।
এস এম হাসানুজ্জামান, লেখক, কলামিস্ট, রংপুর
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন