একসময় বিকেল হলেই তরুণ-যুবকেরা মাঠমুখী হতো। খেলাধুলায় মেতে তারা শরীরচর্চা করত, মানসিক প্রশান্তি পেত, সন্ধ্যা হলে ফিরে যেত পড়ার টেবিলে। আজ সেই দৃশ্য প্রায় হারিয়ে গেছে। মাঠ ফাঁকা, মাঠের জায়গা দখল হয়ে গেছে কংক্রিটে, আর তরুণদের অবসর ভরে উঠছে মোবাইল স্ক্রিনে। সেখানে শুধু বিনোদন নয়, ক্রমবর্ধমান ভয়াবহ আসক্তির নাম, অনলাইন জুয়া। মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েবসাইটভিত্তিক অনলাইন বেটিং। ফেসবুক-ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে হাজারো বিজ্ঞাপন। যেখানে লোভনীয় অফারের নামে তরুণদের টেনে নেওয়া হচ্ছে এক অন্ধকার আসক্তির জগতে। এক ক্লিকেই লাখ লাখ টাকার মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয়, অথচ বাস্তবে এ খেলায় জেতার চেয়ে হারার সম্ভাবনাই শতভাগ। জয়ী হয় কেবল চক্রের নিয়ন্ত্রকেরা, আর নিঃস্ব হয় দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
রূপালী বাংলাদেশে ‘অনলাইন জুয়ায় জ্বলছে তরুণরা’ শিরোনামের বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৫০ লাখ তরুণ-যুবক অনলাইন জুয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তারা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করছে, আর স্থানীয় এজেন্টরা এই লেনদেন থেকে শতকরা কমিশন নিয়ে কোটিপতি বনে যাচ্ছে। অন্যদিকে হাজার হাজার তরুণ তাদের পড়াশোনা, চাকরি, এমনকি পারিবারিক জীবনের সবকিছু হারিয়ে ফেলছে। কেউ কেউ হতাশায় আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে। সমাজে বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা, চুরি, প্রতারণা ও নানা অপরাধ। মাদকের মতোই ভয়াবহ এই আসক্তি আজ পুরো জাতিকে উদ্বিগ্ন করছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘অনলাইন জুয়া মাদকের মতোই মস্তিষ্কের গঠন ও চিন্তাশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাতভর খেলা, ঘুমের ঘাটতি ও আর্থিক ক্ষতির ফলে তরুণ প্রজন্ম নানা শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় পড়ছে। এটি নিছক মজা নয়, বরং জাতীয় ভবিষ্যতের জন্য এক গভীর হুমকি।’
আশার কথা হলো, সরকার ইতোমধ্যে সাড়ে তিন হাজারের বেশি জুয়ার ওয়েবসাইট বন্ধ করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শতাধিক চক্রকে আটক করেছে।
কিন্তু তাতে কার্যত কোনো স্থায়ী সমাধান আসেনি। প্রতিটি সাইট বন্ধ হওয়ার পরই ভিপিএন ব্যবহার করে সেগুলো আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে এই সমস্যাকে কেবল ওয়েবসাইট বন্ধ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। এ জন্য প্রয়োজন বহুমাত্রিক উদ্যোগ।
প্রথমত, অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। ফেসবুক, ইউটিউব কিংবা যেকোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে দায়বদ্ধ করতে হবে, যাতে তারা বাংলাদেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এসব বিজ্ঞাপন বন্ধ করে। দ্বিতীয়ত, বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে কড়া নজরদারি চালাতে হবে। জুয়ার টাকার লেনদেনে যেসব এজেন্ট জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তৃতীয়ত, প্রয়োজন বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এসব অপরাধের দ্রুত বিচার।
এর বাইরেও পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজকেও দায়িত্ব নিতে হবে। অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে সন্তানের মোবাইল ব্যবহারে। শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে জুয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে। গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে চালাতে হবে সচেতনতামূলক প্রচারণা।
অনলাইন জুয়ার ভয়াবহতা ঠেকাতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়, সরকারের সব সংস্থা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও গণমাধ্যমকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। একটি প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। কারণ তরুণ সমাজ হারিয়ে গেলে হারাবে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎও।
আমরা আশা করব, সরকার আরও কঠোর আইনি পদক্ষেপ ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারির মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার মতো এই বিষাক্ত প্রবণতা বন্ধ করতে কার্যকর ভূমিকা রেখে দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে।