ঢাকা শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি বন্ধ হোক

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫, ০১:০০ এএম

বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবন, সবকিছুই বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। অথচ গুরুত্বপূর্ণ খাতটি দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতি, লুটপাট ও অস্বচ্ছ নীতির শিকার। স্বাধীনতার পর থেকে একের পর এক সরকার বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও বাস্তব চিত্র হলো, এই খাত দুর্নীতিবাজ আমলা-রাজনীতিক-ব্যবসায়ী চক্রের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এর সবচেয়ে বড় ও ভয়ংকর রূপ ফুটে উঠেছে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায়।

বৃহস্পতিবার রূপালী বাংলাদেশে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদনে এ প্রকল্পের হরিলুটের চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রকল্পের মাফিয়া ছিলেন ড. আহমদ কায়কাউস নামের এক সচিব। কনসালটেন্ট নিয়োগ থেকে কেন্দ্র অনুমোদন সব জায়গায় ছড়ি ঘোরাতেন তিনি। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হওয়ার সুযোগে নিজের স্বেচ্ছাচারিতা দিয়ে বিদ্যুৎ খাতকে বানিয়েছিলেন হরিলুটের কারখানা।

২০০৯ সালে বিদ্যুৎ সংকট কাটানোর জন্য সাময়িক সমাধান হিসেবে নেওয়া হয় কুইক রেন্টাল প্রকল্প। এর উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো। কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হয় লুটপাটের এক নতুন অধ্যায়। সাবেক সচিব আবুল কালাম আজাদের করা দায়মুক্তি আইনের ফলে কুইক রেন্টাল প্রকল্পগুলো আইনি সুরক্ষা পেয়ে যায়। অর্থাৎ এখানে যেকোনো অনিয়ম, দুর্নীতি কিংবা রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় ঘটলেও তার জবাবদিহি করা যাবে না। এ সুযোগেই জন্ম নেয় বিদ্যুৎ খাতের ভয়ংকর মাফিয়াচক্র।

ড. আহমদ কায়কাউস ২০১৭ সালে সচিব পদে দায়িত্ব পেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগকে কৌশলে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি কেবল দেশীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গেও লেনদেন করে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই পাচার হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। তার দুর্নীতির ধরনও ছিল আলাদা দেশে নগদ ঘুষ নিতেন না, বরং কনসালট্যান্সি প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিদেশে টাকাগুলো বৈধ করতেন। যুক্তরাষ্ট্রে তার স্ত্রী ও কন্যার নামে একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে।

এখানে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক দিক হলো, দুদক ও এনবিআর তদন্ত শুরু করলেও সেটি অনুসন্ধান পর্যায়েই সীমাবদ্ধ রয়েছে। অদৃশ্য শক্তি তাকে রক্ষা করছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একদিকে বিদ্যুৎ খাতে জনগণের কষ্টার্জিত টাকার পাহাড় গড়েছে বিদেশে, অন্যদিকে সেই টাকার দায় এখনো বহন করছে সাধারণ মানুষ।

বিদ্যুৎ খাতের এই দুর্নীতি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয় নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য বড় হুমকি। জনগণের টাকায় দেওয়া ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ নামের অযৌক্তিক ব্যবস্থা আজও বহাল রয়েছে। সরকার বিদ্যুৎ কিনুক বা না কিনুক, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে কোটি কোটি টাকা দিতে হচ্ছে। অথচ জনগণ লোডশেডিং থেকে মুক্তি পাচ্ছে না, বিদ্যুতের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে এবং সাধারণ মানুষের জীবনে বাড়ছে ভোগান্তি।

আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি বন্ধ করা এবং খাতটিকে স্বচ্ছ করা। জনগণ চায়, কায়কাউসসহ বিদ্যুতের কালো বিড়ালদের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হোক। দুর্নীতি দমন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও সাহসী তদন্তের সুযোগ দিতে হবে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প অনুমোদন ও চুক্তির ক্ষেত্রে স্বাধীন ও স্বচ্ছ কমিশন গঠন করা জরুরি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দায়মুক্তি আইনসহ সব অযৌক্তিক বিধান বাতিল করতে হবে। অন্যথায় নতুন কায়কাউস জন্ম নেবে, আবারও একইভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিদেশে পাচার হবে।

আমরা আশা করব, জনগণের কষ্টার্জিত টাকা যেন আর লুটপাটের শিকার না হয়, সেই নিশ্চয়তা দিতে সরকার কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। অন্যথায়, দেশের মানুষের স্বার্থ ও উন্নয়নের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।