গোপালগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে রেইনট্রি গাছে লাক্ষা পোকার আক্রমণকে স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে ‘ভাইরাস’ নামে ডাকেন। কিন্তু আসলে এটি ভাইরাস নয়, এটি হলো প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এক ধরনের আঠালো পদার্থ, যা লাক্ষা পোকার বসবাস ও জীবনচক্রের সময় তৈরি হয়। এই আঠা বিক্রি করে বর্তমানে শত শত পরিবার সংসার চালাচ্ছে। অনেকে আবার এটিকে জীবিকার প্রধান উৎসে পরিণত করেছেন। এ ভাইরাস বিক্রি করে লাভবান হওয়ায় অনেকে নিজ পেশা ছেড়ে ‘ভাইরাস পোকা’ বিক্রির পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।
জেলার মুকসুদপুর উপজেলার ভাবড়াশুর, মোচনা, পশারগাতী ইউনিয়নসহ সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে লাক্ষা সংগ্রহ। রাস্তাঘাটে কিংবা গ্রামীণ চত্বরে চোখ রাখলেই দেখা যায় ভ্যানগাড়িভর্তি রেইনট্রির ডাল। অনেকেই আবার আগেভাগে রাস্তার পাশের গাছের বাগান কিনে রেখেছেন ভবিষ্যতের জন্য।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রেইনট্রি গাছের সংক্রমিত ডালগুলো চিহ্নিত করার পর গাছের মালিকের সঙ্গে দরদাম ঠিক করা হয়। এরপর ডাল কেটে আনা হয় বাড়িতে। নারী শ্রমিকরা ডাল থেকে আঠালো অংশ ছাড়ান। এ কাজে তারা প্রতি কেজিতে মজুরি পান ৩০ টাকা।
সংগ্রহ করা লাক্ষা স্থানীয় বাজারের আড়তে বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকায়। কয়েক বছর আগে দাম ছিল কেজিপ্রতি ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা। দাম কমে গেলেও এখনো অনেকের কাছে এ পেশা লাভজনক। অন্য পেশার পাশাপাশি এ কাজ করে বাড়তি আয় করছেন অনেকেই।
ভাবড়াশুর ইউনিয়নের যুবক রাজন মিয়া জানালেন, ‘আমরা কয়েকজন মিলে ভ্যান নিয়ে ডাল সংগ্রহ করি। পরে শ্রমিক দিয়ে আঠা ছাড়িয়ে বাজারে বিক্রি করি। আগে দাম বেশি ছিল, এখন দাম কমলেও ভালোই আয় হয়।’
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (গোবিপ্রবি) সাবেক শিক্ষার্থী সোহেল রানা বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি লাক্ষা ব্যবসায় যুক্ত হয়েছি। আমরা ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকায় কিনে ৫৫০ টাকায় বিক্রি করি। দাম আগে অনেক বেশি ছিল, তবে এখনো সংসার চালানোর মতো আয় হয়।’
আড়তদার গোপালগঞ্জ সদরের সোহেল শেখ জানান, গাছ থেকে আঠা সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে কিনে আমরা অন্য জায়গায় বিক্রি করি। এগুলো কেজিপ্রতি ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা দরে কিনে ৫৫০ টাকা দরে বিক্রি করি।
স্থানীয়দের মতে, সঠিকভাবে লাক্ষা সংগ্রহ ও চাষাবাদ করলে বেকার যুবকেরা নিজেদের উদ্যোগে কাজ শুরু করতে পারে। এতে একদিকে বেকারত্ব ঘুচবে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগও তৈরি হবে। বিশেষজ্ঞদেরও মতামত, লাক্ষা সঠিকভাবে বাণিজ্যিকীকরণ হলে এটি দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।
মুকসুদপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. বাহাউদ্দীন সেখ বলেন, ‘মানুষ যেটিকে ভাইরাস বলছে সেটি আসলে ভাইরাস নয়, এটি লাক্ষা পোকা। বর্তমানে রেইনট্রি গাছে এটির উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। অনেকেই সংগ্রহ করে বিক্রি করছেন।’
গোবিপ্রবি উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড. নাসিমা বেগম বলেন, ‘লাক্ষা পোকা গাছের ডালে তাদের জীবনচক্র পার করে। এ সময় ডালের গায়ে সাদা রঙের আঠালো পদার্থ জমা হয়। এই আঠা দিয়ে উন্নতমানের বার্নিশ, গালা, আসবাবপত্রের রঙ এবং প্রসাধনী সামগ্রী তৈরি করা হয়।’