মধ্যপ্রাচ্যবাসীদের কাছে ইসরায়েলি হামলা এখন নিত্যদিনের সংগীতে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি আগ্রাসন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ফিলিস্তিন, লেবানন এবং সিরিয়ার বাসিন্দারা এটিকে জীবনের একটি ‘অংশ’ মনে করছেন। তারা এটিকে সমর্থন করছেন না; তবে এই জুলুম থেকে পরিত্রাণের পথও খুঁজে পাচ্ছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে চলমান ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে ফিলিস্তিন যখন রাষ্ট্র হিসেবে ফ্রান্সসহ আরও ছয় দেশের স্বীকৃতি পেল, তখনো ফিলিস্তিনের নাগরিকেরা ইসরায়েলি হামলা মোকাবিলা করছেন। অন্যদিকে, দক্ষিণ লেবাননের প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একজন নিহত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে ইসরায়েলি হামলায়। এখানকার বাসিন্দারা বলছেন, ইসরায়েলি বাহিনীর ধৃষ্টতা এত বেশি যে, আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে তাদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে।
সম্প্রতি রাশিয়ার নিজনি নভোগরদ শহরে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ ফেস্টিভ্যাল অ্যাসেম্বলি-২০২৫’ এ অংশ নেন দুই লেবানিজ সাংবাদিক। তাদের একজন আলি হুসাইন দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসনের চিত্র তুলে ধরে সাংবাদিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, লেবাননের মধ্যে মিকা এবং দক্ষিণ লেবাননের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সেখানে প্রায় প্রতিদিনই ইসরায়েলি বাহিনী বোমা নিক্ষেপ করছে। যখন খুব ভালো সময় যায়, তখন হয়তো এক দিন পরপর এই হামলা হয়। বোমা নিক্ষেপের পাশাপাশি ইসরায়েলি বাহিনী সশরীরেও এখানকার বাসাবাড়িতে হামলা করে। দক্ষিণ লেবাবন থেকে সীমান্তরেখা অতিক্রম করে ভূখ-ে প্রবেশ করে ইসরায়েলি বাহিনী। তারপর সেখানকার বাড়িঘরগুলোয় অভিযান চালায়, কোনো কোনো বাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করে। এক বছর আগে দক্ষিণ লেবাননের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল পুরোপুরি দখল করে রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী।’
গত সপ্তাহেও অঞ্চলটিতে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। বোমা নিক্ষেপের আগে তারা ঘোষণা দিয়েছে যেন দক্ষিণ লেবাননে সেখানকার বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। আলী হুসাইন বলছেন, ‘অতীতে বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ে যেত তবে এখন অনেকেই তাদের বাসাবাড়িতে থাকেন। কারণ তারা উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন, ইসরায়েলি বাহিনীর এই হামলা এখন তাদের জীবনের নিত্যদিনের সঙ্গী। তাদের জীবনযাপনে এখন ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা অন্তর্ভুক্ত।’ আলী হুসাইন বলেন, ‘ইসরায়েলি হামলার তথ্য থাকলে মানুষজন ৩-৪ ঘণ্টার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। কেউ অন্য গ্রামে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে যায়। তবে এখন বাসিন্দাদের মাঝে যাওয়ার আগ্রহ কমছে। কতবার যাবে? আমরা এখন বুঝে গেছি যে, এই হামলা সঙ্গে নিয়েই জীবনযাপন করতে হবে। হামলা সমর্থন করছি না এবং এর প্রতিবাদ থেকেও বিরত হচ্ছি না। আমাদের সাধ্যমতো জবাব দিচ্ছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিদিন বিভিন্ন রকম কাজ যেমন আমরা করি, তেমন এটাও এখন আমাদের জীবনের অংশ। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দুই বছর ধরে এই যুদ্ধ চলছে। এখন আর লেবানিসরা বাড়িঘর ফেলে কোথাও গিয়ে শরণার্থী হতে চায় না। মৃত্যু হলেও তারা নিজেদের বাড়িতেই থাকতে চান।’
এমন পরিস্থিতিতে এখানকার বাসিন্দাদের মানসিক অবস্থা তুলে ধরে আলী হুসেইন বলেন, ‘দক্ষিণ লেবাননে এমন পরিস্থিতি নতুন কিছু না। যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং ইসরায়েলি শত্রু নিয়ে ৪০ বছরের বেশি সময় বসবাস করছি। এই হামলা মোকাবিলা করতেই হবে; তাই নিজেদের অবস্থানে থেকে পুরো পৃথিবীকে তারা দেখাতে চায় যে, নিজেদের ভূমিতে থাকা, তাদের অধিকার।’
অদূর ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না বলেও মনে করেন এই সাংবাদিক। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ লেবাননের প্রতিটি বাড়ি থেকে অন্তত একজন ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন। ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতাও সম্ভব না। কাজেই এই সমস্যার তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান নেই। লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের সাধারণ মানুষদের বাঁচাতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে এগিয়ে আসতে হবে।’
ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ ফেস্টিভ্যাল অ্যাসেম্বলিতে আসা লেবাননের আরেক সাংবাদিক হাসান ফাকিহ বলেন, ‘ইসরায়েল যা করছে তাতে লেবাননে খুবই কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। গাজা, লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়া এবং সম্প্রতি দোহায় (কাতার) যা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে, ইসরায়েল হচ্ছে ‘ক্রিমিনাল’। নেতানিয়াহু (ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী) ক্রিমিনাল। ট্রাম্প (মার্কিন প্রেসিডেন্ট) নেতানিয়াহুকে অর্থ এবং অস্ত্র দিচ্ছে, আমাদের হত্যা করার জন্য। ইসরায়েল টিকে থাকলে আমরা কেউ বেঁচে থাকব না। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আরব দেশগুলোর এগিয়ে আসা উচিত।’
হাসান ফাকিহ আরও বলেন, ‘ইসরায়েল যখন ইচ্ছা তখন লেবাননে হামলা করছে। শুধু লেবাননে না, অন্যান্য আরব দেশ এবং আফ্রিকাতেও হামলা করছে। অথচ জাতিসংঘে যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবে টানা সপ্তমবারের মতো ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মাঝেও লেবাননের সব মানুষ একত্র হয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা হচ্ছে। সব ধর্মের লেবানিজ একে অপরের হাতে হাত রেখে এই দুঃসময় পার করছে।’
ফেস্টিভ্যালে অংশ নেওয়া ফিলিস্তিনি তরুণী ও পেইন্টার জয়নব জাবের বলেন, ‘‘এখানে যাদের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে, সবাই আমাকে ‘সুপার হিরো’ বলছে কারণ আমি ফিলিস্তিন থেকে এসেছি। তারা জানে যে, ফিলিস্তিনের অবস্থা কী। তাদের কাছে আমাদের দেশের কথা তুলে ধরছি। ফিলিস্তিন আসলেই বিপদের মাঝে আছে এবং তারা সেটি উপলব্ধিও করছেন।’’