দেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, সবজি, এমনকি লবণ ও ডিমের মতো পণ্য নি¤œ ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষের মুখে একটাই কথা, ‘দ্রব্যমূল্য নামক পাগলা ঘোড়ার পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা ক্লান্ত, আমাদের বাঁচান।’ জীবনযাত্রার ব্যয় এমনভাবে বেড়েছে, অনেক পরিবারে এখন তিন বেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
সরকার বিভিন্ন সময় বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিলেও বাস্তবে তার প্রভাব খুব সামান্যই দেখা যাচ্ছে। প্রশাসনের অভিযান, টিসিবির বিক্রয় কার্যক্রম কিংবা পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার ঘোষণার পরও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। কারণ, বাজারে আছে এক দল অসাধু সিন্ডিকেট যারা পণ্যের সরবরাহ ও মজুত নিয়ন্ত্রণ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। এ চক্রই প্রতিদিন নতুন অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে, আর তার বোঝা বইছে সাধারণ মানুষ।
বাজার ব্যবস্থায় অরাজকতা শুধু ভোক্তার জন্যই নয়, অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় ভোগ কমে যাচ্ছে, অভ্যন্তরীণ বাজারে স্থবিরতা তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে জ্বালানি, গ্যাস ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে। ফলে একদিকে কৃষক বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ভোক্তা দিচ্ছেন অতিরিক্ত মূল্য এ যেন এক অদ্ভুত বৈপরীত্য।
এ পরিস্থিতিতে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের দায়িত্ব আরও বাড়ে। শুধু প্রশাসনিক অভিযান নয়, বাজারের কাঠামোগত সংস্কার এখন সময়ের দাবি। পাইকারি বাজারে ডিজিটাল মনিটরিং, পণ্য পরিবহন ও মজুত ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, আমদানিনির্ভরতার পরিবর্তে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে আরও কার্যকর ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সিন্ডিকেটের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের যোগসাজশ থাকলে কোনো পদক্ষেপই ফলপ্রসূ হবে না। আর দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাই। তাই দরকার কঠোর আইন প্রয়োগ এবং ন্যায়সঙ্গত বাজার ব্যবস্থার নিশ্চয়তা।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের জীবনমান রক্ষার জন্য দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা এখন জরুরি। বাজারকে অরাজকতা থেকে মুক্ত করতে না পারলে সামাজিক অস্থিরতা অনিবার্য হয়ে উঠবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী কিংবা মধ্যবিত্ত গৃহিণী, সবাই কম-বেশি বলছেন, বাজেট অনুযায়ী বাজার করা এখন আর সম্ভব নয়। একসময় ১ হাজার টাকায় সপ্তাহ চললেও এখন আড়াই হাজার টাকাতেও সংসার চলে না। ডাল, ভর্তা, শাক দিয়ে দিন পার করা মানুষের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটি সহজেই অনুমেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে দেশের সামষ্টিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। সরকার যদি বাজারে কার্যকর মনিটরিং না চালায়, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, তবে এই অস্থিরতা শুধু আরও বাড়বে।
আমরা মনে করি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে প্রথমত, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে সরাসরি সংযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। তৃতীয়ত, মনিটরিং ও মূল্য নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যকর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।
এখন সময় এসেছে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার। দরকার হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অসাধু ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি ভোক্তাদের সচেতন করাও জরুরি, যেন তারা যৌক্তিক দাম ছাড়া পণ্য না কেনেন এবং অসঙ্গতির প্রতিবাদ করেন।
জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম ধরে রাখা সরকারের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ভবিষ্যতে শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিতেও পারে। তাই, এখনই দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে হবে, নইলে মূল্য দিতে হবে বড় পরিসরে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন