রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২৫, ০২:৪২ এএম

বাতি নিভছে ক্রমাগত

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২৫, ০২:৪২ এএম

বাতি নিভছে ক্রমাগত

শফি ভাই (জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কবি, কথাসাহিত্যিক মুস্তাফিজ শফি) তার ফেসবুক আইডিতে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের প্রয়াণে লিখেছেন, ‘আশা জাগিয়েও ফিরলেন না তিনি। যতীন সরকার, আহমদ রফিকের পথে অবশেষে হাঁটলেন প্রিয়জন সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও। একে একে সব আলো নিভে যাচ্ছে। নির্ভরতার জায়গাগুলো ছোট হয়ে আসছে। কিছুই ভালো লাগছে না। বিষণœতায় ছেয়ে আছে মন। অস্থির লাগছে।’

সত্যিই নির্ভরতার জায়গাগুলো ছোট হয়ে আসছে। বেদনার পর বেদনার পাহাড়চাপা পড়ছে আমাদের সব স্বপ্ন-আশা। বাতি নিভছে ক্রমাগত। অন্ধকারই যেন আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক,  কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্যসমালোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে  মাথা নুইয়ে ফের উচ্চারণ করি, যতীন সরকার, আহমদ রফিক কিংবা সৈয়দ মনজুরুল ইসলামরা যুগে যুগে জন্মান না। অর্থাৎ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের খ্যাতি একাধারে শিক্ষক, লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে এবং সর্বোপরি একজন বড় মাপের মানুষ হিসেবে। মুক্তচিন্তার জগতে তার অবদান নিশ্চয় অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। 

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন ৪৩ বছর এবং তিনি সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়টির ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন। আমরা জানি, সত্তরের দশকে বাংলা সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় তার। এরপর  দীর্ঘদিন স্বেচ্ছা বিরতি দিয়েছিলেন সাহিত্যচর্চায়। এ জগতে আবার ফিরে আসেন আশির দশকে এবং একেবারে নতুনভাবে বলা যায় ভিন্ন রূপে সাহিত্যে পদচারণা শুরু করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বিশেষত ‘গল্পের’ জগতে তার বিচরণ ছিল খুব দাপুটে। কিছু দিন ধরে তিনি প্রথাগত গল্পধারার বাইরে বেরিয়ে এসে এক ভিন্ন শৈলিতে লিখতে থাকেন। অত্যন্ত, সহজ, সাবলীল ভাষায় লেখা তার গল্পগুলো সবসময় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, তা এ জগতে বিচরণকারী প্রায় সবার জানা ।

নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯৪), থাকা না থাকার গল্প (১৯৯৫), কাচ ভাঙ্গা রাতের গল্প (১৯৯৮), অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প (২০০১), প্রেম ও প্রার্থনার গল্প (২০০৫) , সুখ-দুঃখের গল্প, বেলা অবেলার গল্প ইত্যাদি তার পাঠকনন্দিত গল্পগ্রন্থ। আলোচিত উপন্যাস হলো : আধখানা মানুষ্য (২০০৬), দিনরাত্রিগুলি, আজগুবি রাত, তিন পর্বের জীবন ইত্যাদি। আর  প্রবন্ধ ও গবেষণাগ্রন্থ : নন্দনতত্ত্ব (১৯৮৬), কতিপয় প্রবন্ধ (১৯৯২), অলস দিনের হাওয়া, মোহাম্মদ কিবরিয়া, সুবীর চৌধুরীর সহযোগে রবীন্দ্রানাথের জ্যামিতি ও অন্যান্য শিল্পপ্রসঙ্গ। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, শামসুর রাহমানেরর ওপর তার উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম রয়েছে। অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬) , একুশে পদকসহ  (২০১৮) অন্যান্য সম্মাননা ও পুরস্কার।

তিনি সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন ১৮ জানুয়ারি ১৯৫১ সালে। তার বাবার নাম সৈয়দ আমীরুল ইসলাম এবং মা রাবেয়া খাতুন। তিনি সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিক পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন সিলেট এমসি কলেজ থেকে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইয়েটসের কবিতায় ইমানুয়েল ইডেনবার্গের দর্শনের প্রভাব বিষয়ে পিএইচডি করেন।

গত ১ জুলাই ২০২৪ শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার জাতীয় প্রেসক্লাবে  বলেছিলেন, ‘শিক্ষার মান ক্রমাগত নামছে এবং একেবারেই মুখস্থবিদ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাকরি পাওয়াটা একজন শিক্ষার্থীর জীবনের প্রধান ইচ্ছা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধরনের অবস্থা কোনো জাতির জন্য ভালো ইঙ্গিত দেয় না। দেশে মুক্তবুদ্ধিচর্চার অনেক প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে।’ 

স্যার, শুধু কি তাই? আপনার প্রয়াণে বেদনায় ভরে আছে জীবন-পেয়ালা। এর মাঝেও বলি, আপনাদের চলে যাওয়া ক্রমেই যে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করছে তাতে আরও বহুমাত্রিক দুর্ভিক্ষ দৃশ্যমান হবে এবং ভয়টা সেখানেই। এ মহার্ঘ ক্ষতি তো পুষিয়ে নেওয়া যাবে না, কোনোভাবেই না। অনস্বীকার্য, প্রজন্মের প্রাসঙ্গিকতা আমাদের সমাজে গভীর। তরুণ সমাজ যেন জানতে পারে সেই প্রজন্মের মূল্যবোধকে। এ প্রজন্ম যেন জানে, তাদের পূর্বসূরিরা কারা, কে ছিলেন। কিন্তু পূর্বসূরিদের ভুলিয়ে দেওয়া কিংবা রাখার যে অপপ্রক্রিয়া ক্রমাগত প্রকট হচ্ছে তাও নিশ্চয় খুব দুর্ভাবনার বিষয়। অসত্য  নয়, আমাদের অনেক কালো ইতিহাস আছে। কিন্তু সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার প্রত্যাশা রেখে গেছেন, এই কালো ইতিহাসের ভেতরেও সুন্দর বিকাশগুলো আছে, সেগুলোকে স্পর্শ করুক, আমাদের এই প্রজন্ম। আমাদের মনে রাখা দরকার, খুব দরকার বাতি নেভানো ঝড়ের দাপট বড় মর্মবেদনার।    

এও অসত্য নয় , এক নিদারুণ বৈপরীত্যর মধ্যে চলছে, আমাদের বসবাস কিংবা যাপিত জীবন। একদিকে মুক্তচিন্তার বন্দিত্ব যেমন বাড়ছে ঠিক তেমনি অন্যদিকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকের দাসত্বও এ বৈপরীত্যর প্রেক্ষাপট তৈরি করছে। এ নেতিবাচকতার ছায়া যাদের আলোয় অপসারিত হতে পারে এ প্রদীপগুলো নিভে যাচ্ছে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার এ প্রদীপগুলোর মধ্যে নিভে যাওয়া আরেকটি প্রদীপ। আমাদের বাতিঘরগুলোর কপাট বন্ধ করে দেওয়ার হীন চেষ্টা এ যাবৎ কম হয়নি। এই অপপ্রক্রিয়াগুলোর যথাযথ প্রতিবিধান করা ছিল যাদের দায়-দায়িত্ব তারা থেকেছেন নির্বিকার তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের জন্য নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও অনেকের মতো বরাবরই এসবের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। আমরা এ প্রেক্ষাপটে আরেকটি কণ্ঠ হারালাম। এই যে ক্ষয়ে যাওয়া এও তো আমাদের জন্য বড়, অনেক বড় মহার্ঘ ক্ষতি।       

স্যার, আপনাকে প্রণতি। স্যার, আপনাকে চিরবিদায় কিংবা চিরপ্রপ্রস্থান এ শব্দগুলোয় বৃত্তবন্দী করব না। কারণ, আপনিও আমাদের সংশপ্তক। আপনাকেও আমরা ধারণ করে চলব আমাদের প্রয়োজনেই। বেদনাকাতর চিত্তে মৃদুভাষী মনজুরুল ইসলামের আত্মার শান্তি কামনা করি।

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু 
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কবি ও গল্পকার  

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!