আমরা এক অদ্ভুত সাংস্কৃতিক অবস্থার মধ্যে বেঁচে আছি। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও চিন্তায়, চর্চায়, রুচিতে আমরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল। নিজেদের ঐতিহ্য, নিজেদের গল্প, নিজেদের শিল্পÑ সবকিছুই যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে অন্যের প্রভাবের ভেতর। আমরা নিজেদের সংস্কৃতিকে লালন করতে পারি না, কারণ আমরা নিজেদের ভালোবাসতে শিখিনি। আত্মপরিচয়ের জায়গাটিতে এখন অন্যের আলো, অন্যের জনপ্রিয়তা, অন্যের সৌন্দর্যবোধ ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় একটি অংশ ভারতীয় সংস্কৃতির গভীর ছায়ায় বেড়ে উঠেছে। ছোটবেলা থেকে টেলিভিশনের পর্দায়, ইউটিউবের ভিডিওতে, সিনেমা হলেÑ সবখানে ভারতের উপস্থিতি। প্রিয় নায়ক, প্রিয় গায়ক, প্রিয় লেখকÑ সবই ভারতীয়। ভারতীয় সিনেমা বা সিরিজে তারা যেভাবে নিজেদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, দর্শনীয় স্থান বা ইতিহাসকে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরে, তা আমাদের মুগ্ধ করে। সেই মুগ্ধতা থেকেই জন্ম নেয় অনুসরণ। ফলে মুখে যতই ‘ভারত বয়কট’ বলা হোক, ভারতীয় সিনেমা দেখা বন্ধ হয় না, বরং টুরিস্ট ভিসা বা চিকিৎসা ভিসার লাইনে ভিড় আরও বাড়ে। এটা আসলে কোনো রাজনৈতিক ভালোবাসা নয়Ñ বরং এক সাংস্কৃতিক পরাধীনতা। আমরা যাদের সমালোচনা করি, তাদের কাছ থেকেই আমাদের রুচির মানদ- তৈরি হয়। এ যেন প্রতিবাদও অন্যের ভাষায় উচ্চারিত হয়।
এলিট শ্রেণির জীবনও এর বাইরে নয়। গুলশান, বনানী বা ধানমন্ডির বহু পরিবারে বাংলা বই পড়া বা বাংলায় কথা বলাকে আজ এক ধরনের লজ্জা হিসেবে দেখা হয়। তাদের সন্তানরা হয়তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা সমরেশ মজুমদারকে চেনে না, কিন্তু ‘ঋৎরবহফং’ সিরিজের প্রতিটি চরিত্রের নাম মুখস্থ জানে। কিন্তু ভাবতে হয়Ñ এই কোরিয়ান বা জাপানি সংস্কৃতি কেন বিশ্বে জনপ্রিয়? কারণ তারা নিজেদের ঐতিহ্য ও শিল্পরুচিকে আধুনিকতার সঙ্গে মিলিয়ে নতুন করে বিশ্বে উপস্থাপন করেছে। অথচ আমরা নিজেদের ঐতিহ্যকে ‘গ্রামীণ’ বা ‘অপরিপক্ব’ ভেবে দূরে ঠেলে দিয়েছি।
বাংলাদেশে আরও একটি অংশ আছে, যারা নিজেদের আরব বা পাকিস্তানি সংস্কৃতির অনুকরণে গর্ববোধ করে। তারা মনে করে, আরবি পোশাক, ভাষা বা রীতিনীতি মানেই ধর্মীয় শুদ্ধতা। এই মানসিকতা আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়কে নষ্ট করছে নিঃশব্দে। কারণ ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতির একাত্মতা থাকলেও তার প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়। আমাদের সংস্কৃতি নদীভিত্তিক, মাটিভিত্তিক, কৃষিনির্ভরÑ যেখানে বাউল, জারি-সারি, পালাগান, ভাটিয়ালি, পল্লিগীতি সবই মিশে আছে। আজকের প্রজন্ম জানে না লালনের দর্শন কী, কিংবা ময়মনসিংহ গীতিকার গল্প কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু পাকিস্তানের পুরোনো গজল বা আরবি নাশিদ তাদের প্লেলিস্টে জায়গা পায়। এই অন্ধ অনুকরণ আমাদের পরিচয় মুছে দিচ্ছে প্রতিদিন।
আর যা সবচেয়ে উদ্বেগজনক, ক্রমেই বেশিসংখ্যক তথাকথিত ‘পাকিস্তানপ্রেমী’ এখন গর্বের সঙ্গে নিজেদের রাজাকার বলে ডাকে, যেটা একসময় বিশ্বাসঘাতকতা আর গণহত্যার পরিচয় ছিল। যারা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী সেই চিন্তাভাবনাকে আজ তারা মহিমায় উপস্থাপন করছে, এটা শুধু ইতিহাস ভুলে যাওয়া নয়; এটা গভীর সাংস্কৃতিক ও নৈতিক সংকট। এ রকম পরিচয়বিভ্রান্তি দেখায় আমরা আমাদের মুক্তির চেতনা থেকে কতটা দূরে চলে গেছি।
আমাদের বাঙালিত্বও আজ সংকটে। আমাদের সাহিত্য ও শিল্প পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যচর্চার প্রভাব বহন করে, এটি সত্য। তবে তার মানে এই নয় যে, আমরা নিজস্ব কিছু তৈরি করতে পারিনি। আমাদের লোকসংস্কৃতি, পল্লিসাহিত্য, গ্রামীণ শিল্পÑ এসবই আমাদের আলাদা পরিচয়ের অংশ। কিন্তু আমরা সেগুলোকে শহরের জীবনে স্থান দিতে পারিনি। আমাদের তরুণেরা আজ ভাটিয়ালির কথা জানে না, কিন্তু জাপানি এনিমের চরিত্রের পোশাকে কসপ্লে করে। আমাদের গান, নাটক, সিনেমা নিজেদের সমাজের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পারেনি; বরং বিদেশি ফরম্যাটের নকল হয়ে গেছে। তাই প্রশ্নটা থেকে যায়Ñ আমরা আসলে কারা?
রাজনীতির মঞ্চে ভারতীয় আধিপত্য নিয়ে যতই গর্জন তোলা হোক, বাস্তবে রাজনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য ও কূটনীতি সেই একই বন্ধনে বাঁধা। পূজায় ইলিশ পাঠানো আর নির্বাচনের সময় ভারতবিরোধী স্লোগানÑ এই দ্বৈততা আসলে কৌশলের, আদর্শের নয়। আমরা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার কথা বলি, কিন্তু নিজের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে কোনো উদ্যোগ নেই। যতদিন না আমরা নিজেদের শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, পোশাক, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারব, ততদিন ভারতীয় বা পশ্চিমা প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে পর্যটন ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রেও একই অবহেলা। রাজবাড়ি, প্রতœস্থান, প্রাচীন মন্দির, পুরোনো বৌদ্ধবিহার সবকিছু অবহেলায় পড়ে আছে। সরকার কিংবা বেসরকারি উদ্যোগ কোনো পক্ষই সেগুলোর পুনর্গঠনে আন্তরিক নয়। অথচ এগুলোই হতে পারত আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের দৃশ্যমান প্রতীক। আমাদের নিজেদের ইতিহাসের প্রতি উদাসীনতা এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন আমরা নিজের ঐতিহ্য দেখাতে লজ্জা পাই।
সংস্কৃতি মানে শুধু গান, পোশাক বা উৎসব নয়Ñ সংস্কৃতি মানে আমাদের চিন্তা, জীবনধারা, ভাষা, সাহিত্য, ও সৌন্দর্যবোধ। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ্যক্রমে আমাদের লোকসংগীত, বাউল দর্শন, নাট্যঐতিহ্য ও স্থানীয় সাহিত্য অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। সিনেমা ও মিডিয়াকে ব্যবহার করতে হবে আমাদের সংস্কৃতিকে আধুনিকভাবে উপস্থাপন করার জন্য। আর সবচেয়ে বড় কাজÑ নিজের ভাষা ও ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করতে শেখা।
যেদিন আমরা নিজের গান শুনে মুগ্ধ হব, নিজের ভাষায় লেখা বই পড়ে অনুপ্রাণিত হব, যেদিন আমরা নিজেদের ঐতিহ্যকে অন্যের চোখে নয়, নিজের চোখে ভালোবাসবÑ সেদিনই হয়তো বলতে পারব, আমরা সত্যিই স্বাধীন।
নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়