এক সময় রাজধানীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ছিল প্রতিটি পাড়ার প্রাণকেন্দ্র, শিশুদের শিক্ষা ও আনন্দের আশ্রয়স্থল। সেখানে ছিল খোলা মাঠ, সবুজ আঙিনা, গাছপালা। শিশুদের কলোকাকলিতে মুখর থাকত আশপাশ। অথচ আজ সেই সব বিদ্যালয় একে একে সংকীর্ণ হচ্ছে দখল, দূষণ ও প্রশাসনিক উদাসীনতার কুয়াশায়। ঢাকার প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে। এক সময় যে বিদ্যালয়গুলো শিশুদের জন্য ছিল শিক্ষা ও খেলাধুলার আশ্রয়স্থল, আজ সেগুলোর অধিকাংশই দখল, দূষণ ও অব্যবস্থাপনার কবলে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। স্কুলের মাঠে গড়ে উঠছে বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলীয় কার্যালয় কিংবা ওয়াসার পাম্প। অনেক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব এখন শুধু একটি সাইনবোর্ডে সীমাবদ্ধ।
তেজগাঁও থানাধীন পূর্ব রাজাবাজারের রোটারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইতিহাস যেমন, তেমনি এর পতনও প্রতীকী। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়ের ছিল ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ জমি, যার মধ্যে একটি বড় খেলার মাঠ ছিল শিশুদের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মাঠ, সেই জায়গা হারিয়ে গেছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের দখলে। সরকার পরিবর্তনের পর শুধু নাম পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু দখলমুক্ত হয়নি। বাস্তবতা অপরিবর্তিত। স্কুলের ২২৮ শিক্ষার্থীর জন্য আজ কোনো মাঠ নেই, নেই শুদ্ধ আলো-বাতাস প্রবাহিত শ্রেণিকক্ষ। বিদ্যুৎ চলে গেলে অন্ধকারে ডুবে যায় ক্লাসরুম, বন্ধ হয়ে যায় পাঠদান।
এই এক বিদ্যালয় নয়। রাজধানীজুড়ে শত শত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একই করুণ বাস্তবতায় নিমজ্জিত। মোহাম্মদপুর, রমনা, মতিঝিল, মগবাজার, মিরপুরসহ পুরো রাজধানীজুড়ে একই চিত্র। কোথাও বিদ্যালয়ের জমিতে ওয়াসার পাম্প, কোথাও বাজার, কোথাও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কোথাও রাজনৈতিক কার্যালয়। রমনা রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিতে এখন কাঁচাবাজার, মতিঝিলের বিদ্যালয়গুলোর জমিতে ওয়াসার পাম্প, মিরপুরে সরকারি স্কুলের জায়গায় বহুতল ভবন। রাজধানীর অনেক বিদ্যালয়েই খেলার মাঠ দূরে থাক, ভবনের বাইরে পা রাখার জায়গাটুকুও নেই।
সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ হলো, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে এসব বিদ্যালয়ের জমির পূর্ণাঙ্গ তথ্য পর্যন্ত নেই। তাদের নথিতে ঢাকার মাত্র ৩৫টি বিদ্যালয় বেদখল বলে উল্লেখ আছে, অথচ বাস্তবে ৯৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের জমিই কোনো না কোনোভাবে দখলকৃত। আরও ভয়ংকর তথ্য হলো, ঢাকা বিভাগের ৪ হাজার ৭৭০টি বিদ্যালয়ের জমি এখনো প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের নামে রেকর্ডভুক্ত নয়। অর্থাৎ, প্রশাসনিক অবহেলার কারণে এই জমিগুলোর কোনো বৈধ মালিকানা সরকারের নেই। ফলে দখলদাররা যেভাবে চাইছে, সেভাবেই ব্যবহার করছে এসব জায়গা।
এই পরিস্থিতি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয় বরং এটি গভীর সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো একটি সমাজের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের মূল ভিত্তি। অথচ আমরা সেই ভিত্তির ওপরই দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি কলোনি, দোকান, বাজার আর রাজনৈতিক ভবন। যেখানে শিশুরা খেলার কথা, সেখানে চলছে দখলবাজির রাজনীতি।
এই বাস্তবতা শুধু শিক্ষা নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলার মাঠের অভাবে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুরা স্থবির হয়ে পড়ছে, স্থূলতা বাড়ছে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে। খেলাধুলা না থাকায় তারা ডিভাইসে আসক্ত হচ্ছে, আর সেটাই দীর্ঘমেয়াদে তাদের জীবনে নৈতিক অবক্ষয় ও মানসিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যখন একটি প্রজন্ম আলো-বাতাসবঞ্চিত, খেলাধুলাবিহীন পরিবেশে বড় হয়, তখন তারা কেবল পাঠ্যবই মুখস্থ করা মানুষ হয়। কিন্তু প্রকৃতি ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
সুতরাং সময় এসেছে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বে ফিরে যাওয়ার।
আমরা চাই, শিশুরা আবার মাঠে ফিরে যাক। তারা যেন নিশ্বাস নিতে পারে মুক্ত বাতাসে, হাসতে পারে আকাশের নিচে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো হোক সেই মুক্ত পরিবেশের প্রতীক। যেখানে শিক্ষা কেবল বইয়ের পাতা নয়, জীবনের আনন্দে ভরপুর এক অভিজ্ঞতা। সরকারি বিদ্যালয়ের জমি দখলমুক্ত করে সেই আনন্দ ফিরিয়ে আনতে হবে।
আমরা আশা করব, শিক্ষা অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসনসহ সবপক্ষের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে একটি জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করে সরকারি বিদ্যালয়গুলোর জমি উদ্ধার ও পুনর্বিন্যাস করবে সরকার। সেই সঙ্গে দখলদারদের আইনের আওতায় এনে জবাবদিহিতার মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। তবেই একটি পরিপূর্ণ প্রজন্ম গড়ে উঠবে। যারা নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে।

