বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে মব-সহিংসতা বা গণপিটুনির ঘটনা এক অস্বীকার্য বাস্তবতা হিসেবে সামনে এসেছে। এই ধরনের নৃশংসতা শুধু ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বা সহিংসতা নয়; বরং এটি সমাজ, রাজনীতি, আইন এবং নৈতিকতার মধ্যে গভীর ফাঁক এবং ক্রমশ ভেঙে পড়া কাঠামোর দৃষ্টান্ত। গত ১৩ মাসে পিটিয়ে হত্যার অন্তত ৪৬টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যেখানে কমপক্ষে ৬৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৬ ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে, কিন্তু ১০ ঘটনার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। মামলার আসামির সংখ্যা ৯,০০০-এর বেশি, যেখানে শুধু ২৭ মামলায় ১১৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং মাত্র ৬ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে। এমন তথ্য প্রমাণ করে যে, গণপিটুনির ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া অপ্রতুল, অসম্পূর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রেই কার্যত বন্ধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার মতে, গণপিটুনি প্রায়ই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, গুজব বা ভুল তথ্যের কারণে সংঘটিত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হলেও পুলিশ উপস্থিতি অনেক প্রাণ রক্ষা করেছে। কিন্তু সমস্যার মূল কোর হলো সামাজিক দায়বোধের অভাব, প্রশাসনিক অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং দীর্ঘসূত্রতা বিচার প্রক্রিয়া। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আইনজীবী সারা হোসেন মন্তব্য করেছেন, ‘বিচার না হলে অন্যায় চলতেই থাকে।’ বাস্তবে এই ধারা শিশু, প্রতিবন্ধী ও নারীর মতো সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণিকে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তোফাজ্জল হোসেন, কুমিল্লার রোকসানা বেগম এবং রংপুরের রূপলাল রবিদাস এই ধরনের উদাহরণ। শিশু বা একক উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু শুধু মানসিক নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ধসও সৃষ্টি করে। রূপলালের ছেলে জয় পড়াশোনা ছেড়ে জুতা সেলাইয়ের কাজে যুক্ত হয়েছেন, যা প্রমাণ করে হত্যার পর পরিবারের আর্থিক ও সামাজিক স্থিতি কতটা বিপন্ন হয়। একে শুধুই মৃত্যু হিসেবে দেখা যাবে না; এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের সূচনা।
মব-সহিংসতা প্রতিরোধে একাধিক স্তরে পদক্ষেপ অপরিহার্য। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। প্রতিটি ঘটনার যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং জনগণকে বোঝানো যে আইনই একমাত্র বৈধ বিচারব্যবস্থা। রাষ্ট্র ও প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও, জনগণ সচেতন না হলে প্রতিরোধ প্রায় অসম্ভব। তৃতীয়ত, ভুক্তভোগী পরিবারকে পুনর্বাসনের মাধ্যমে শিক্ষা, জীবিকা ও মানসিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
মব-সহিংসতার পেছনে প্রায়শই ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক স্বার্থ এবং সামাজিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাজ করে। যেমন রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুজনকে মারধর করা হয়েছিল। এছাড়া পুরান ঢাকার লালচাঁদ হত্যা দেখিয়েছে, যে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বও গণপিটুনির বিস্তার ঘটাতে পারে। চলতি বছরের জুলাইয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে হত্যাকা- সংঘটিত হয়, যেখানে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিচারহীনতা রোধ করার জন্য রাষ্ট্রকে একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ তৈরি করতে হবেÑ যে কেউ অপরাধ করলে আইন নিজে কার্যকর হবে।
এটি রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী বা ধর্ম নির্বিশেষে প্রযোজ্য। ভুক্তভোগী পরিবার পুনর্বাসনের দায়িত্বও রাষ্ট্রের। রূপলাল রবিদাসের পরিবার দেখিয়েছে, শিক্ষা, আর্থিক সহায়তা এবং মানসিক সমর্থনের মাধ্যমে শিকারদের জীবনযাত্রার যোগ্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা এবং মানসিক সমর্থন নিশ্চিত করাই মূল চ্যালেঞ্জ। বিচারহীনতা, সামাজিক উদাসীনতা এবং প্রশাসনিক তৎপরতার অভাব মিলে বাংলাদেশে মব-সহিংসতার সংস্কৃতি জন্ম দিয়েছে। রাষ্ট্রের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া এই চক্র ভাঙা সম্ভব নয়। মানবাধিকার সংস্থা, সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
আইন এবং মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। জনগণকে বোঝাতে হবে, ‘মব-জাস্টিস’ বা গণপিটুনি কখনো ন্যায়বিচার নয়; এটি সামাজিক অস্থিরতা, ভীতি এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন বৃদ্ধি করে। শিক্ষিত, নৈতিক এবং সচেতন সমাজই ভবিষ্যতে এই ধরনের হত্যাকা-ের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পারে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবও গুরুতর। হত্যার শিকার ব্যক্তির পরিবার শুধু মানসিক ক্ষতি নয়, বরং আর্থিক দিক থেকেও দুর্বল হয়ে পড়ে। একক উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু পরিবারের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতি বিপন্ন করে, সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ হয় এবং সংসার পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ে। এটি প্রমাণ করে, মব-সহিংসতার প্রভাব শুধু হত্যার মাত্রায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
প্রশাসনিক, আইনগত ও সামাজিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হলে কিছু মৌলিক পদক্ষেপ অপরিহার্য: দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করা, ভুক্তভোগী পরিবারকে পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন দেওয়া, জনগণের মধ্যে সামাজিক নৈতিকতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা, এবং পুলিশ ও প্রশাসনের দক্ষতা উন্নয়ন করা। মব-সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষিত, নৈতিক এবং সচেতন সমাজই ভবিষ্যতে এই ধরনের হত্যাকা-ের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পারে। রাষ্ট্রের কার্যকর পদক্ষেপ থাকলেও, জনগণ সচেতন না হলে কার্যকর প্রতিরোধ সম্ভব নয়।
যেসব হত্যাকা- আলোচিত হয়নি বা গ্রেপ্তার হয়নি, সেগুলো বিচারহীনতার কারণে পরিবারগুলো মামলা করতে অনীহা প্রকাশ করে। সামাজিক চাপ, ভীতি এবং শত্রু সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা আইন প্রয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। এটি প্রমাণ করে যে, শুধু আইন নয়, সামাজিক সচেতনতা এবং মানসিক নিরাপত্তাও অপরিহার্য। মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা জরুরি। বিচারহীনতা, গণপিটুনি এবং মব-সহিংসতার সংস্কৃতি শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না, এটি সমাজে ভীতি, অনৈতিকতা এবং নৈতিক অবক্ষয়ও সৃষ্টি করে। প্রতিটি হত্যাকা- সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকটের বহির্প্রকাশ। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশে মব-সহিংসতা ও বিচারহীনতার চক্র ভাঙতে হলে সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন।
সামাজিক সচেতনতা, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচার, ভুক্তভোগী পরিবার পুনর্বাসন, এবং নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে আমরা একটি নিরাপদ, মানবিক এবং ন্যায়পরায়ণ সমাজের সূচনা করতে পারি। বিচারহীনতা চলতে থাকলে অন্যায় চলতেই থাকবে, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ এবং সামাজিক সচেতনতা মিলে এমন উদাহরণ তৈরি করা সম্ভব, যেখানে কেউ অপরাধ করে পার পাবে নাÑ যেকোনো ব্যক্তি, দল বা ধর্মেরই হোক না কেন। মব-সহিংসতা শুধু অপরাধ নয়; এটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতার প্রতিফলন। আইন, নৈতিকতা এবং নাগরিক দায়িত্ব একত্রে কাজ করলে ভবিষ্যতে এই ধরনের নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিচারহীনতার ভয়ঙ্কর চক্র ভেঙে, বাংলাদেশে ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
রাফায়েল আহমেদ শামীম, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক

