গত ৪ নভেম্বর, রাশিয়ার অর্থমন্ত্রী আন্তন সিলুয়ানোভ ঘোষণা করেন যে, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে প্রায় সব বাণিজ্য (৯৯.১ শতাংশ) পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে কেবল রুবল ও ইউয়ানে সম্পন্ন হয়েছে। এটি শুধু একটি পরিসংখ্যানগত বিষয় নয়, বরং এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের ইঙ্গিত, যেখানে আমেরিকান ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য আজ অবসানের পথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম বৈশ্বিক বাণিজ্যের কেন্দ্র কেবল ওয়াশিংটন বা ওয়াল স্ট্রিটকে বাদ দিয়ে আবর্তিত হচ্ছে।
কয়েক বছর আগেও মস্কো-বেইজিংয়ের প্রায় প্রতিটি লেনদেন পশ্চিমা ব্যাংক ও ডলার-ইউরোর মাধ্যমে সম্পন্ন হতো, এবং তা নিয়ন্ত্রিত ছিল সুইফটের মতো পশ্চিমÑ প্রভাবিত ব্যবস্থার অধীনে। কিন্তু সেই বিশ্ব এখন অতীত। ইউক্রেন যুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ঢল এমন এক অর্থনৈতিক রূপান্তর ঘটিয়েছে যা কোনো অর্থনৈতিক তত্ত্ব তা করতে পারেনি। পশ্চিমা ঋণ, রিজার্ভ ও ডলার লেনদেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়া বাধ্য হলো নতুন বাণিজ্যিক দিক খুঁজতে। ফলাফল, রাশিয়া-চীন বাণিজ্যের ৯৯ শতাংশ এখন পশ্চিমা মুদ্রা ছাড়া সম্পন্ন হচ্ছে।
রাশিয়াকে একঘরে করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উল্টো তাকে এশিয়ার সঙ্গে আরও গভীরভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এ থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলোÑ বাধা এবং সংকট মানুষকে উদ্ভাবনে বাধ্য করে। যখন পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার সম্পদ জব্দ করেছিল, ব্যাংকিং অ্যাকসেস বন্ধ করে সম্পূর্ণ অর্থনীতি ধ্বংসের হুমকি দেয়, তখন গোটা গ্লোবাল সাউথ বুঝে গিয়েছিল- ওয়াশিংটনের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে কোন দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা।
বিশ্বের অনেক দেশের জন্য এটি ছিল এক সতর্কবার্তা। এখন তারা এই ‘ডি-ডলারাইজেশন’ বা ডলারের নিরুঙ্কুশ আধিপত্য রোধকে বিদ্রোহ নয়, বরং আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে দেখছে। ‘অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব’ আজ নতুন যুগের স্লোগান, যা একসময় শুধু রাজনৈতিক তাত্ত্বিকদের আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল।
রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল আগুনের স্ফুলিঙ্গ, কিন্তু কাঠি অনেক আগে থেকেই জ্বলছিল। ইরান, ভেনেজুয়েলা, কিউবা, আফগানিস্তানÑ প্রতিটি ক্ষেত্রে ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ফলে তার নিরপেক্ষতার প্রতি আস্থা কমেছে। প্রতিটি নিষেধাজ্ঞাই বিশ্বকে মনে করিয়ে দিয়েছেÑ ডলার আর কেবল মুদ্রা নয়, এটি এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম।
এ শূন্যস্থানে উঠে এসেছে রুবল ও ইউয়ান। নিষেধাজ্ঞার চাপের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে এক নতুন আর্থিক বাস্তবতা। এখন মস্কো ও বেইজিংয়ের বাণিজ্য আর ডলারভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে না। তহবিল স্থানান্তর হচ্ছে সরাসরি দেশীয় ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। চীনের ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম (ঈওচঝ) এখন ১৮৫টি দেশের প্রায় ৫,০০০ ব্যাংককে যুক্ত করেছে, সম্পূর্ণভাবে সুইফটকে এড়িয়ে।
রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার নোভাক সম্প্রতি জানিয়েছেন, চীন ও ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার ৯০-৯৫ শতাংশ বাণিজ্য এখন দেশীয় মুদ্রায় সম্পন্ন হচ্ছে। এ পরিবর্তন কোনো গণতান্ত্রিক পরিকল্পনার ফল নয়; এটি বাজারের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। রুশ কোম্পানিগুলো বুঝে গেছে যতদিন তারা ডলারের উপর নির্ভর করবে, ততদিন তাদের অর্থনৈতিক শিরা কেটে দেওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
রাশিয়া একা নয়। ব্রিকস দেশগুলোও এখন স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য নিষ্পত্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ দিচ্ছে যাতে ঋণগ্রহীতারা ডলারের ওঠানামার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে। আসিয়ান দেশগুলোও আঞ্চলিক লেনদেনের জন্য ডলারনির্ভরতা কমাতে আগ্রহী হচ্ছে।
ডি-ডলারাইজেশনকে কেউ কেউ ভুলভাবে আমেরিকাবিরোধী আন্দোলন বলে মনে করে। আসলে এটি তা নয়। এর মূল লক্ষ্য ডলারকে ধ্বংস করা নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক করা, যাতে কোনো একক দেশ অন্যদের ওপর অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে। এই প্রথম বিশ্বজুড়ে প্রশ্ন উঠছে, একটি মাত্র মুদ্রা কি পুরো আন্তর্জাতিক বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত?
এটি মূলত এক ধরনের দার্শনিক পরিবর্তন। প্রায় এক শতাব্দী ধরে ডলার ছিল স্থিতিশীলতা, আস্থা ও পূর্বাভাসের প্রতীক। এখনো ২০২৪ সালে এটি বৈশ্বিক রিজার্ভের প্রায় ৫৯ শতাংশ দখল করে আছে। এটি একটি বিশাল অংশ, তবে ২০০০ সালের ৭১ শতাংশ থেকে ধীরে ধীরে তা কমছে। এ পতন ধীর হলেও ধারাবাহিক। এখন যদি রাশিয়া-চীন বিকল্প মডেল দেখাতে পারে, তবে এ গতি আরও বাড়বে।
চীনের জন্য এটি দীর্ঘমেয়াদি ধৈর্যের বিজয়। বেইজিং বহুদিন ধরেই ইউয়ানকে আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা করছে, কিন্তু পশ্চিমাদের সন্দেহ ও কঠোর মূলধন নিয়ন্ত্রণ সেটিকে এতদিন বাধা দিয়ে আসছিল। এখন রাশিয়ার এই বিচ্ছিন্নতা ইউয়ানকে বাস্তব লেনদেনের মুদ্রা হিসেবে নতুন ভূমিকা দিয়েছে। ইউয়ানের মাধ্যমে জ্বালানি বাণিজ্য প্রক্রিয়াটি চীন কেবল ছাড়মূল্যে রুশ তেল-গ্যাস পাচ্ছে না, বরং নিজের মুদ্রাকেও শক্তিশালী করছে।
তবে এতে ঝুঁকিও আছে। রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান চীননির্ভরতা বেইজিংকে অতিরিক্ত প্রভাব দিচ্ছে, যা মস্কোর কাছে ভবিষ্যতে অস্বস্তিকর হতে পারে। কিন্তু আপাতত বাস্তবতা প্রয়োজনকে ছাপিয়ে গেছে।
চীনের অর্থনৈতিক কূটনীতি এখন রাশিয়ার বাইরে আরও প্রসারিত হয়েছে। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ ইউয়ান ক্লিয়ারিং সেন্টার চালু করছে। এক সময় তেল বাণিজ্যে অন্য মুদ্রার কথা ভাবাও অসম্ভব ছিল, কিন্তু এখন তা এক নতুন বাস্তবতা।
ব্রিকস-কে একসময় কেবল একটি তথাকথিত জোট হিসেবে মনে করা হতো কিন্তু আজ তা এক সমান্তরাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিণত হচ্ছে। ব্রিকসের নতুন পেমেন্ট সিস্টেম পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত সুইফট ছাড়াই আন্তর্জাতিক লেনদেনের সুযোগ দেবে। ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের স্থানীয় মুদ্রায় ঋণদান এক প্রকারের নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক স্বাধীনতা প্রদান করে।
তবে এ পরীক্ষা চ্যালেঞ্জবিহীন নয়। ব্রিকস সদস্যদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মডেল এক নয়। ভারত ও ব্রাজিল পশ্চিমা সম্পর্ক বিবেচনা করে সতর্ক, অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ়। কিন্তু ধীরগতির এ অগ্রযাত্রাও তাৎপর্যপূর্ণ। ইতিহাস বলে, আর্থিক বিপ্লব কখনো তাৎক্ষণিক হয় নাÑ তা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে।
ওয়াশিংটন অবশ্য বিষয়টি গভীরভাবে লক্ষ্য করছে। মার্কিন প্রশাসন অবশ্য সতর্ক করেছেন যে, ডলার এড়িয়ে চলা দেশগুলোর ওপর নতুন শুল্ক বা নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। কিন্তু এই হুমকিই ডলার কূটনীতির দুর্বলতা প্রকাশ করে। বিকল্প ব্যবস্থা যতই দমন করার চেষ্টা করা হবে, তাদের অস্তিত্বের যুক্তি ততই শক্তিশালী হবে।
অর্থনৈতিক প্রভাব সর্বদাই উৎপাদনশীল শক্তির অনুসারী। বিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ পাউন্ডের জায়গা নেয় আমেরিকান ডলার, কারণ ডেট্রয়েট ও পিটসবার্গের কারখানাগুলো তখন বার্মিংহাম ও ম্যানচেস্টারকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আজ যখন শিল্প ও সম্পদ উৎপাদন পূর্বমুখী হচ্ছে, অর্থব্যবস্থাও সেই পথে এগোচ্ছে।
সিলুয়ানোভের ঘোষণাটি এক ধরনের স্বাধীনতার ঘোষণা যা রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক। রুবল-ইউয়ান জোট ডলারের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র নয়; এটি বিশ্ব অর্থনীতির নতুন বাস্তবতার স্বীকৃতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম বৈশ্বিক বাণিজ্য সত্যিকারের বহুমুখী হয়ে উঠছে।
ডলার রাতারাতি হারিয়ে যাবে না, কোনো মুদ্রাই যায় না। তবে এর নিরঙ্কুশ আধিপত্য শেষ হচ্ছে। সামনে আসছে এক বিভাজিত কিন্তু ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বÑ যেখানে মস্কো রুবলে, বেইজিং ইউয়ানে, রিয়াদ রিয়ালে, আর নয়াদিল্লি রুপিতে লেনদেন করবে। এটি হয়তো কখনো কখনো জটিল হবে, কিন্তু নিঃসন্দেহে তা হবে আরও ন্যায্য ও বহুমাত্রিক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে জন্ম নেওয়া ডলার যুগ বিশ্বকে দিয়েছে স্থিতিশীলতা এবং একইসঙ্গে নির্ভরশীলতা। এখন নতুন যুগের সূচনা হয়েছে যেখানে নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিরোধের আগুনে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন ধারণা: বহুমাত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হবে। ডলার এখনো শক্তিশালী, কিন্তু তা আর একক শক্তি নয়।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন