ঢাকা শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫

হাসিনার ফাঁসির রায় কী বার্তা দিল?

মাহতাব মুহাম্মদ, গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০২৫, ১২:২৩ এএম

মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্ট থাকায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-ের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ১৭ নভেম্বর সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্যান্য সদস্যরা হলেনÑ বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। ঘোষিত রায়ে বলা হয়েছে, হাসিনাসহ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি অভিযোগে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে। দুটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদ- দেওয়া হয়েছে। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদ- ও সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনকে রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হওয়ার কারণে ৫ বছরের সাজার ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল। রায় ঘোষণার পর শেখ হাসিনা ফাঁসির আদেশকে পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করেছে। এর আগে হাসিনা বিচারপ্রক্রিয়াকে ‘প্রহসন’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল। এদিকে রায় ঘোষণার আগে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বিদেশে বসে দেশকে অস্থিতিশীল করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার মাকে কী করতে পারবে? আমার মা ভারতে নিরাপদে আছেন।’ আরেক মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি আসাদুজ্জামান খান কামাল তার মৃত্যুদ-ের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালকে অবৈধ দাবি করে বলেছে, ‘বাংলাদেশের মানুষ এ রায় অ্যাক্সেপ্ট করবে না।’ তাদের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায়, হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেও হাসিনা ও তার দলের লোকদের কোনো অনুশোচনা নেই। এত এত চাক্ষুষ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নির্লজ্জের মতো দম্ভোক্তি করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কারো ন্যূনতম মনুষ্যত্ব থাকলে এত এত অপরাধ করার পর এ রকম দম্ভোক্তি করতে পারে না। মানুষ হিসেবে কিছুটা হলেও অনুশোচনাবোধ জাগার কথা ছিল। কিন্তু হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বোধ হয় অন্য কোনো প্রজাতির। গুম-খুন-নির্যাতন-নিপীড়ন করার পরও তাদের মধ্যে ন্যূনতম অপরাধবোধ নেই। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল বর্তমানে ভারতে পলাতক আছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ- ভারত প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত এই দুই আসামিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য ভারতকে আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু তাতে ভারতের দৃশ্যমান আগ্রহ দেখা যায়নি। এদিকে হাসিনার ফাঁসির রায়ের পর ভারত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ভারত বলেছে, ‘ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি, স্থিতিশীলতা ও জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের প্রতি ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা এই লক্ষ্যে সবসময় সকল অংশীদারদের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কাজ করে যাব।’ ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ‘এই রায় পাকিস্তানের নির্দেশে দেওয়া হয়েছে। এ রায় কার্যকর হবে না। হাসিনা প্রগতিশীল।

শেখ হাসিনা অন্য দেশের হলেও তিনি বাঙালির সংস্কৃতির (আদতে ভারতীয় সংস্কৃতির) সঙ্গে যুক্ত।’ এ উক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদী এই নেতা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ক্ষমতায় থাকাকালীন হাসিনা মূলত ভারতের তাঁবেদারি ও স্বার্থসিদ্ধ করত। রায়ের বিরুদ্ধে হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল আপিল করার সুযোগ পাবে না। কারণ আইনি বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করে কিংবা গ্রেপ্তার হওয়ার পর আপিল করতে হয়। পলাতক অবস্থায় আপিল করার সুযোগ নেই। তাই ধরে নেওয়া যায়, এ রায়টিই চূড়ান্ত রায়। মৃত্যুদ-ের আদেশের পাশাপাশি ট্রাইব্যুনাল আসামিদের সম্পদ জব্দ করে তা জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজে ব্যয় করতে বলেছেন। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আওয়ামী সরকার। পরে ২০১২ সালের মার্চে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তৎকালীন ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার। হাসিনা সরকার দ্বারা গঠিত ট্রাইব্যুনালে বেশকিছু জামায়াত নেতা, বিএনপি নেতা ও অন্যান্য কিছু লোকের বিচার কার্যক্রম চলে। তাতে বেশকিছু নেতার মৃত্যুদ-াদেশ প্রদান করা হয় ও পরে তা কার্যকর হয়। সে সময়কার ৩০টি মামলা এখনো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন আছে।

২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং একই বছরের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হয়। এরপর ২০২৪ সালেরই নভেম্বর মাসে ট্রাইব্যুনাল আইনে বেশকিছু সংশোধনী আনা হয়। পুনর্গঠিত হওয়া এই ট্রাইব্যুনালে গত বছরের ১৪ আগস্ট সাবেক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। দীর্ঘ ১৫ মাসে পরোয়ানা জারি থেকে শুরু করে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ, অভিযোগ দাখিল, সাক্ষ্যগ্রহণসহ যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের প্রতিটি কাজ আন্তর্জাতিক আইনের মানদ- মেনে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও ন্যায্য বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। বিচারপ্রক্রিয়ার কোথাও জবরদস্তিমূলক কিছু ছিল না। কারণ আসামিদের কৃতকর্মের সাক্ষী আছেন সারা দেশের লাখো সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি মিডিয়ার শত শত সাংবাদিক। আদালতে পঠিত ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ে বিচারের বিবরণ তুলে ধরা হয়। মৃত্যুদ- দেওয়া হাসিনার মামলায় যেসব অভিযোগ আনা হয়, তা ছিল দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ। প্রথম অভিযোগ ছিল উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান। দ্বিতীয় অভিযোগ ছিল প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ। গুরুতর এ অভিযোগটি হাসিনার ফাঁস হওয়া কল রেকর্ড থেকে সহজেই প্রমাণিত হয়, যেখানে হাসিনা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সরাসরি নির্দেশ দেয়। হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারীদের গুলি করার নির্দেশনা দেওয়ার কথা অডিও কল রেকর্ডে শুনতে পাওয়া যায়। ফাঁসকৃত অডিও কল রেকর্ডটি যে শেখ হাসিনারইÑ তা আল জাজিরা ও বিবিসির ফরেনসিক টেস্ট করে নিশ্চিত হয়েছে। এ ছাড়াও হাসিনার বিরুদ্ধে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে পুলিশের মাধ্যমে গুলি করে হত্যা, রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জন আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা এবং সাভারের আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর জীবিত একজনসহ পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ আনা হয়। সবগুলো অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিটি অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও চাক্ষুষ সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে হত্যার নির্দেশনা দেওয়া অডিও কল রেকর্ডসহ বিভিন্ন অডিও-ভিডিও রেকর্ড ছিল, যার মাধ্যমে হাসিনার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া ৫৪ জন সাক্ষী আদালতে এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন। জাতিসংঘও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, আন্দোলন চলাকালে হাসিনা অন্তত ১৪০০ মানুষ হত্যা করেছে। বিচারপ্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও প্রকাশ্য। হাসিনার আমলের বিচারপ্রক্রিয়ার মতো ‘স্কাইপ কেলেঙ্কারি’ কিংবা বিচারের রায় ঘোষণার পর আইন সংশোধনের মতো বিতর্কিত কোনো ঘটনা ছিল না। বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানদ- মেনে। কোনো ধরনের লুকোছাপা ছিল না। দেশবাসী বিচারপ্রক্রিয়া ও রায় লাইভ সম্প্রচারের মাধ্যমে সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে। হাসিনার মৃত্যুদ-ের রায়ে শহিদ পরিবার, আহত জুলাইযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কোথাও কোথাও মিষ্টি বিতরণের ঘটনাও ঘটেছে। তবে রায়কে ঘিরে কট্টর আওয়ামী সমর্থকদের কিছু অংশ শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী বাস পুড়ানো, ককটেল বিস্ফোরণসহ বিভিন্ন সহিংস কাজ করেছে। হাসিনার বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ের মাধ্যমে একটা বিষয় প্রমাণিত হয়েছে, যেটি হলোÑ অপরাধী যতই ক্ষমতাধর হোক, স্বৈরাচার যতই দুর্ধর্ষ ও নৃশংস হোক, তাকে বিচারের মুখোমুখি হতেই হয়। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে কতই না দুর্ধর্ষ, দুর্দ- প্রতাপশালী ও নৃশংস ছিল হাসিনা। গুম, খুন, আয়না ঘর নির্মাণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- সংঘটিত করার পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী গোষ্ঠীকে দমন-পীড়ন-হামলা- মামলায় কোণঠাসা করার সর্বোচ্চ পথ বেছে নিয়েছিল হাসিনা। কথা-বার্তায়, চলনে-বলনে কী অহংকার প্রকাশ পেত! দম্ভভরে বলত, তাকে ক্ষমতায় থেকে নামানোর কেউ নেই, কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সেই দাম্ভিক স্বৈরাচারীর কী ঐতিহাসিক পতন! আজ সে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দাগি পলাতক আসামি। সময়ের পরিক্রমায় কী ন্যায্য প্রতিশোধ! হাসিনার করুণ অবস্থা থেকে রাজনৈতিক নেতাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। রাজনীতিকরা যাতে অনুধাবন করে যে, ভবিষ্যতে কেউ যদি হাসিনার মতো একইরকম নৃশংস ও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে কিংবা হওয়ার চেষ্টা করে, তবে তার পরিণতিও হাসিনার মতোই শোচনীয় হবে; হবে ঘৃণিত, বিতাড়িত, সর্বোচ্চ দ-প্রাপ্ত কোনো আসামি। এতকিছুর পরও প্রশ্ন রয়ে যায়Ñ রাজনীতিকরা কি আসলেই হাসিনার পরিণতি থেকে শিক্ষা নেবে, নাকি ‘ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না’Ñ এ কথাটির পুনরাবৃত্তি হবে? দেখা যাক। হয়তো সময়ই তা বলে দেবে।