দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি জাতির যে মমত্ববোধ, যে আবেগ, যে অগাধ ভালোবাসা সম্প্রতি অসুস্থতার ঘটনাবলিতে তা যেন আরও স্পষ্টভাবে ধরা দিল। চারিদিকের সমস্ত বিভাজন, মতানৈক্য, রাজনৈতিক বিরোধ ভুলে ১৮ কোটি মানুষ যেন একসঙ্গে হাত তুলল একটি নারীর সুস্থতার জন্য, যে নারীকে তারা দীর্ঘ পথচলার প্রতিটি বাঁকে পেয়েছেন দৃঢ়তা, সাহস আর ত্যাগের এক অবিচল প্রতীক হিসেবে। হাসপাতালের করিডরে তার শয্যার পাশে চিকিৎসকদের ব্যস্ততা যত বাড়ছিল, দেশের মানুষের হৃদয়েও এক অদ্ভুত ব্যথা যেন জমা হচ্ছিল, আর একইসঙ্গে বাড়ছিল মোনাজাতের হাত।
সবশেষে তথ্য অনুযায়ী দেশনেত্রীর অবস্থা স্থিতিশীল। ‘স্থিতিশীলতা’ শব্দটি সাধারণ মানুষের কাছে যতটা অস্বস্তি দেয়, চিকিৎসকদের কাছে ততটাই নির্ভুল নিরূপণ। কেননা, অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে না। তার চেতনা অটুট রয়েছে। যদিও এই চেতনা-অটুট থাকা মানসিক শক্তির পরিচায়ক, শারীরিকভাবে তিনি এখনো ভ্রমণোপযোগী নন। তার পরিবার ও দলের আকাক্সক্ষা, তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া। সিঙ্গাপুর, লন্ডন দুটি বিকল্পই আলোচনায় এসেছে, তবে অগ্রাধিকার লন্ডনেই। তবু শরীরের অনুমতির অপেক্ষা যেন অনিশ্চয়তার দীর্ঘ ছায়া হয়ে আছে।
তাকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রথম দিনে অনেকে ভেবেছিলেন, হয়তো এটি রুটিন চেকআপ। তিনি তো প্রায়ই এভারকেয়ার হাসপাতালে যান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে স্পষ্ট হয়, এটি সেই পরিচিত পরীক্ষা নয়। এটি এমন এক সংকট যেখানে দেশের মনও কেঁপে ওঠে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি মানুষের মনের ভেতর দুশ্চিন্তার স্রোত বইয়ে দেয়। শুধু দলীয় নয়, জাতীয়ভাবে যেন তার জন্য প্রার্থনার ধারা শুরু হয়। মসজিদে মসজিদে মোনাজাত, ঘরে ঘরে দোয়া, হৃদয়ের প্রার্থনায় তার নাম। এমনকি রাজনৈতিক বিরোধিতার ধার ঘেঁষা দলগুলোও দোয়া করেছেন তার দ্রুত আরোগ্যের জন্য। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কঠিন প্রাচীর ভেদ করে এই মানবিক আবেদন উঠে এসেছে মানুষের অন্তরের গভীর থেকে।
এ দৃশ্য দেখে এক অদ্ভুত সত্য আবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বেগম খালেদা জিয়া আজ আর কেবল বিএনপির নেত্রী নন। তিনি বাংলাদেশের এক অবিসংবাদিত ‘মাদার ফিগার’। এই স্বীকৃতি কোনো রাজনৈতিক প্রচারণার ফসল নয়, বরং তার দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ, আপসহীনতা এবং মানবিক নেতৃত্বের প্রতিফলন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম জিয়ার উদ্ভব যেন প্রায় নাটকের মতো। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে রাজনীতির জটিল পথচলা শুরু তার, তাও নিজের কোনো উচ্চাকাক্সক্ষায় নয়। তিনি ছিলেন এক নিখাদ গৃহবধূ, পরিবার, ঘর, সন্তান নিয়ে যার ব্যস্ততা ছিল গভীর, রাজনৈতিক জীবনের বন্ধুর পথ তার জন্য একেবারেই অচিন। অথচ শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নৃশংস হত্যাকা-ের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাকে টেনে নিয়ে আসে ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার নিজ হাতে তুলে দেন দলের গুরুদায়িত্ব। সেই মুহূর্ত থেকেই যেন শুরু হয় এক নারীর রাজনীতিতে পুনর্জন্ম আর নতুন সংগ্রামের পথচলা।
দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর যে পরিবর্তন এসেছিল তার মধ্যে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ। যে নারী ছিলেন গৃহবধূ, তাকেই দেখা গেল রাজপথে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে। জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের সময়ে মিছিলের ময়দানে তাকে টিয়ার গ্যাস, জলকামান, গ্রেপ্তার আতঙ্কের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে অসংখ্যবার। সেদিন পুরানা পল্টনে টিয়ার গ্যাসে আহত হওয়ার পরও কর্মীদের সহায়তায় হাউস বিল্ডিং অফিসের পেছনে সামান্য পানি ছিটিয়ে আবার মিছিলে ফিরে আসা, এ যেন তার রাজনৈতিক জীবনের প্রতীকী ঘোষণা। তিনি বারবার একটি বিষয় স্পষ্ট করেছেন, পিছিয়ে যাওয়ার জন্য নয় বরং লড়াই করার জন্যই জন্মেছেন।
যখন শেখ হাসিনা ১৯৮৬ সালের নির্বাচনকে ‘বেইমানি’র নির্বাচন বলে নিন্দা করেও কিছুক্ষণের মধ্যে তাতে অংশ নিলেন, তখন বেগম জিয়া ছিলেন নির্বাচন বয়কটে অবিচল। এই অটলতা শুধু জনপ্রিয়তা বাড়ায়নি, তাকে দিয়েছে এক বিরল পরিচিতি। আপসহীন দেশনেত্রী।
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের ছিল আলাদা এক সৌন্দর্য। তিনি আপসহীন হলেও ছিলেন গণদাবি মেনে নেওয়ার প্রবল উদারতায় ভরপুর। যার উদাহরণ, ১৯৯১ সালে জনগণের দাবি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি বাদ দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা কিংবা ১৯৯৬ সালে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা। দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে যত বড় সিদ্ধান্তই প্রয়োজন হোক, তিনি হয়েছেন তার প্রধান বাস্তবায়নকারী।
জাতীয় স্বার্থে তার দৃঢ়তা বরাবরই ছিল অনমনীয়। ভারতকে করিডর দেওয়ার প্রশ্নে তার অবস্থান ‘বুকের রক্ত ঢেলে দেব, তবুও দেব না’এই ঘোষণাটি শুধু একটি রাজনৈতিক বিবৃতি নয়, বরং এটি ছিল দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তার অনমনীয় মানসিকতার নিদর্শন। যা কেবল বেগম জিয়ার দ্বারাই সম্ভব।
এক-এগারোর অস্থির রাজনৈতিক ঝড়ে যখন মাইনাস টু ফর্মুলা প্রচার পেল, তখন শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে গেলেও বেগম জিয়া ছিলেন অটল। তিনি তার প্রিয় মাতৃভূমির মাটিকে ছেড়ে যাননি। এই অনড় অবস্থানের কারণে তার পরিবার, বিশেষ করে তারেক রহমান, নির্মম নির্যাতনের শিকার হলেও তিনি নতি স্বীকার করেননি। এ লড়াই তাকে আরও মহিমান্বিত করেছে মানুষের কাছে।
আজ তিনি যখন হাসপাতালে শয্যাশায়ী, তখন মানুষের চোখে শুধুমাত্র একজন রাজনীতিবিদের জন্যই উদ্বেগ নেই। পাশাপাশি উদ্বেগ আছে, এক মাতৃসুলভ ব্যক্তিত্বের জন্য, যিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্থিরতা, শক্তি ও গণতন্ত্রের প্রতীক। আজ তাকে দেশের বড়ই প্রয়োজন, কারণ তিনি সুস্থ থাকলে রাজনীতির অন্ধকারেও আশা দেখা যায়, দিকহারা পথিকের সামনে দিশা দেখার মতো আলো ফোটে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ যেভাবে বারবার বাধার মুখে পড়ছে, সেই পরিস্থিতিতে বেগম জিয়া যেন এক নীরব প্রতিরোধের প্রতীক।
তাকে ঘিরে যে দোয়া, যে প্রার্থনা, সে শুধু একটি ব্যক্তিকে সুস্থ করার আবেদন নয়, এ যেন বাংলাদেশের আত্মাকে সুস্থ রাখার প্রার্থনা। কারণ বেগম খালেদা জিয়া আজ শুধু একটি দলের নয়, তিনি জাতির মায়ের মতো, দুঃসময়ে যার ছায়া, যার দৃঢ়তা, যার অস্তিত্বই মানুষের ভরসা।
বেগম জিয়ার সততা, আপসহীনতা, আধিপত্যবাদ বিরোধিতা এবং ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বেগম জিয়াকে ইতিহাসের শিলালিপিতে কালজয়ী নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই মাদার ফিগারকে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বড়ই প্রয়োজন। চারিদিকে ষড়যন্ত্র। গণতন্ত্র আসি আসি করেও প্রতি পদে বাধা পাচ্ছে।
দেশনেত্রী যদি সুস্থ থাকেন তাহলে বাংলাদেশ সমস্ত বাধার বিন্ধ্যাচল পার হতে পারবে, ইনশাআল্লাহ।

