মানুষের সম্পর্কের ভেতরে এমন কিছু এলাকা আছে, যেগুলো কোনো অভিধানে ঠিকঠাক সংজ্ঞায় পাওয়া যায় না। এগুলো পুরোপুরি বন্ধুত্ব নয়, আবার প্রেমও নয়। যেন দুটো পরিচিত শব্দের মাঝখানে লুকিয়ে থাকা এক নীরব অঞ্চল, যেখানে অনুভূতিগুলো নিঃশব্দে জন্ম নেয়, বড় হয়, কিন্তু প্রকাশের মতো কোনো স্পষ্ট নাম খুঁজে পায় না। এই সম্পর্কের সৌন্দর্যও আসে এই অনুচ্চারিততার মধ্য থেকেই। বলা আর না বলার সেই সূক্ষ্ম দোদুল্যমানতার ভেতর তৈরি হয় একটি আলাদা ভাষা, যা শব্দ দিয়ে নয়, উপলব্ধি দিয়ে ধরা পড়ে।
দুজন মানুষের মধ্যে যখন কোনো অদৃশ্য আকর্ষণ জন্ম নেয়, সেটি প্রথমে চোখে পড়তে পারে আচরণে। কথার মাঝে না বলা কিছু থেকে, কারো মুখের দিকে একটু বেশি করে তাকানো থেকে, অকারণ খোঁজ নেওয়া থেকে, কিংবা একেবারে সাধারণ কোনো বিষয়ে অযথা বাড়তি মনোযোগ দেওয়া থেকে। কেউ কাউকে সরাসরি কিছু জানায়নি, কেউ দাবি করেনি, কেউ নিজের অনুভূতির ওজন চাপিয়ে দেয়নি; তবুও সম্পর্কের ভেতর একটা নীরব পরিবর্তন এসে পড়ে। মনে হয়, সব একই আছে, কিন্তু আবার পুরোপুরি একই নেই।
এই নীরবতার মধ্যেই আসলে সম্পর্কের সবচেয়ে জোরালো আন্দোলন তৈরি হয়। কারণ অনুভূতি এখানে নিজের গতিতে বাড়তে পারে, তাড়াহুড়ো করে কোনো সংজ্ঞা দেওয়ার চাপ থাকে না। আজকের সময়ে যখন মানুষ দ্রুত সম্পর্কের নাম দিতে চায়; বন্ধু, প্রেম, সিচুয়েশনশিপ- এ অনুচ্চারিত সম্পর্ক তার ভেতরই একধরনের বিরল স্বাধীনতা। এখানে কোনো ঘোষণা নেই, কোনো শব্দ নেই; সম্পর্ক নিজস্ব পথেই চলতে পারে, যেমনভাবে তার বেড়ে উঠা স্বাভাবিক মনে হয়।
অনেকে অনুভূতি বলতে চায় না, সম্পর্কের ভেতরের কোমলতা রক্ষা করার জন্য। কারণ বলা মানেই সব সময় ‘হওয়া’ নয়। কখনো বলা মানেই অপ্রয়োজনীয় চাপ তৈরি হওয়া, প্রত্যাশা বাড়া অথবা সম্পর্কের স্বাভাবিক প্রশান্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া। তাই অনেক সময় মানুষ নীরব থাকে। সেই নীরবতা দুর্বলতার চিহ্ন নয়, বরং একটি পরিণত সংযম; যা সম্পর্ককে তাড়াহুড়ো করে ভুল জায়গায় নিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচায়।
অদ্ভুত বিষয় হলো, অনুচ্চারিত সম্পর্কগুলো দখলদার হয় না। এখানে দাবি থাকে না, অধিকার দেখানোর চেষ্টা থাকে না। এই সম্পর্ক একধরনের মানসিক রেজোন্যান্সের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। দুজনেরই মনে থাকে, এটা কাগজে লেখা কোনো পরিচয় নয় বরং এক ধরনের সূক্ষ্ম অনুভূতির সুর। যে সুরের ওপর বেশি চাপ দেওয়া হলে ভেঙে যেতে পারে, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে বাজতে দিলে আরও গভীর হতে থাকে।
এই সম্পর্কের কোনো নির্দিষ্ট নাম নেই, তবু এর গুরুত্ব থাকে বিশাল। সাধারণ বন্ধুত্বের চেয়ে একটু বেশি, কিন্তু প্রচলিত প্রেমের মতো নয়। এর কোনো গন্তব্য ঠিক থাকে না, তবুও পথচলা থামে না। অনেক সময় সম্পর্ক কোথাও পৌঁছায় না, আবার কখনো নীরবতার ভেতর দিয়েই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। তবে সব ক্ষেত্রেই সত্য একটাই, এই সম্পর্ক মানুষের জীবনে এক ধরনের অদৃশ্য উষ্ণতা তৈরি করে, যা অনুভব করা যায়, কিন্তু শব্দে বোঝানো যায় না।
একসময় প্রশ্ন আসে, বলা উচিত কি না? কিন্তু এর কোনো একক উত্তর নেই। বলা যদি নিজের ভেতরের জট খুলে দেওয়ার মতো হয়, তাহলে বলা প্রয়োজন। আর বলা যদি সম্পর্কের স্থিরতা হারিয়ে ফেলার ঝুঁকি তৈরি করে, তবে নীরব থাকাই বুদ্ধিমানের। অনুভূতি কখনোই হিসাবের গণিত নয়; এটি সময়, পরিস্থিতি ও মানুষ অনুযায়ী আলাদা পথে কাজ করে।
শেষ পর্যন্ত অনুচ্চারিত সম্পর্ক আমাদের শেখায়, সব অনুভূতির শব্দ প্রয়োজন হয় না। নামের বাইরে, সংজ্ঞার বাইরে একটি গভীর এলাকা থাকে, যেখানে মানুষ শুধু পাশে থাকলেই যথেষ্ট। এই উপস্থিতির ভেতরেই জন্ম নেয় মানবিক উষ্ণতা, যা দাবি দিয়ে নয়, বোঝাপড়ার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।
সব সম্পর্ককে পুরোপুরি বলা যায় না। অনেক সময় নীরবতাই সবচেয়ে স্পষ্ট কথা বলে দেয়। অনুচ্চারিত সম্পর্ক সেই নীরবতার ওপর দাঁড়িয়েই নিজের জায়গা বানায়; শব্দ ছাড়াই, চাপ ছাড়াই, অথচ দুই মানুষের জীবনে অদ্ভুতভাবে নির্ভরযোগ্য হয়ে থাকে।
আরিফুল ইসলাম রাফি
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

