ঢাকা রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর, ২০২৫

সম্পাদকীয়

স্বাস্থ্যসেবায় টেস্ট-সন্ত্রাস দূর করতে হবে

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০২৫, ০২:৫৬ এএম

দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত দীর্ঘদিন ধরেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক ও রোগীর অনুপাতের ভয়াবহ বৈষম্য, সেবার সীমাবদ্ধতা এবং যান্ত্রিক সুবিধার ঘাটতি মানুষকে বাধ্য করছে বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ছুটতে। যে খাত মানুষের ভরসা হওয়ার কথা, সেটিই আজ পরিণত হয়েছে অমানবিক মূল্য-বৈষম্যের একটি ভয়াবহ বাণিজ্যক্ষেত্রে। যেখানে একই পরীক্ষা এক হাসপাতাল করছে আট হাজার টাকায়, আরেকটি প্রতিষ্ঠান সেই পরীক্ষার দাম রাখছে ১৮ হাজার টাকা। এ যেন এক ধরনের ‘টেস্ট-সন্ত্রাস’। যার শিকার হচ্ছে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত মানুষ।

সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ পরীক্ষা কয়েকগুণ বেশি মূল্যে হওয়াটা নতুন নয়। কিন্তু উদ্বেগজনক বিষয় হলো, একই পরীক্ষা, একই ধরনের মেশিন এবং প্রায় একই প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টেস্টের দামে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কোথাও সিবিসি ৩৫০ টাকা, আবার কোথাও ৭০০। আল্ট্রাসনোগ্রাফি ৭০০ টাকায় যেখানে হয়, কিছু হাসপাতালে সেটিই ১৮০০ টাকার বেশি। এমনকি সাধারণ রক্ত পরীক্ষা, থাইরয়েড, কোলেস্টেরল, ইউরিক এসিড সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় এরকম বৈষম্যের চিত্র।

এ অবস্থায় বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যুক্তি, যন্ত্রপাতির দাম, ব্যবস্থাপনা ব্যয়, বিশেষজ্ঞ টিম, ব্র্যান্ড ভ্যালু ইত্যাদি। নিঃসন্দেহে খরচে ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই যুক্তিগুলো কি এতটাই বড় যে, কোনো পরীক্ষা দ্বিগুণ বা তিনগুণ দামে করতে হবে? নাকি রোগীর অসহায়ত্বকে পুঁজি করে বাড়তি মুনাফা আদায়ের অপকৌশল চলছে? বাস্তবতা বলছে, বাজারে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, নেই একক মানদ- কিংবা স্বচ্ছ ব্যয় কাঠামো। সরকারের কার্যকর মূল্যসীমা না থাকায় ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

হাসপাতালের লোকসান হওয়া খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ডায়াগনস্টিক সেবার দাম বাড়িয়ে রাখা, এখন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার নির্মম বাস্তবতা। এতে পরীক্ষার খরচ বাড়ছে, আর রোগী জিম্মি হয়ে পড়ছে। সরকারি পর্যায়ে ‘ফি নির্ধারণ ও মান নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা’ থাকলেও তা কার্যত অকার্যকর। ন্যূনতম সর্বোচ্চ মূল্যসীমা নেই, কেন্দ্রীভূত ডাটাবেইস নেই, নিয়মিত মনিটরিং নেইÑ সব মিলিয়ে বিশৃঙ্খলার এক অপতরঙ্গ চলছে সারা দেশের স্বাস্থ্য খাতে।

স্বাস্থ্যসেবা কোনো বিলাসদ্রব্য নয়। এটি মানুষের মৌলিক অধিকার। আর মৌলিক অধিকার বাণিজ্যিক স্বেচ্ছাচারের কাছে বন্ধক রাখা যায় না। এ কারণে এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর ভূমিকা অপরিহার্য। প্রথমত, অবিলম্বে সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ন্যূনতম-সর্বোচ্চ মূল্যসীমা নির্ধারণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের টেস্ট-মূল্য অনলাইনে বাধ্যতামূলকভাবে প্রকাশ করতে হবে, যাতে রোগী আগেই জানতে পারে কোথায় কোন দামে পরীক্ষা হচ্ছে। তৃতীয়ত, হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়নে মূল্য-বৈষম্যকে একটি মূল্যায়ন সূচক হিসেবে যুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

সরকারের নীতিমালা থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ শিথিল। নিয়মিত মনিটরিং, লাইসেন্স নবায়ন, যন্ত্রপাতির মান নিয়ন্ত্রণ, রিপোর্টের নির্ভরযোগ্যতা, এগুলোতে বরাবরই অবহেলা চোখে পড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটি রোগীর জন্য পাঁচ-ছয় ধরনের টেস্ট করা হয় শুধু বিল বাড়ানোর জন্য। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর এর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ কখনো কখনো চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়ার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রোগীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাস্থ্যসেবাকে মানবিক ও ন্যায়সংগত করা। বাণিজ্যিক স্বাধীনতার নামে রোগীর পকেট কাটা চলবে না। রোগীদের বিভ্রান্তি, দুশ্চিন্তা ও আর্থিক চাপে ফেলছে যে টেস্ট-বাণিজ্য, সেটি দ্রুত বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবায় ন্যূনতম মান, ন্যায্যমূল্য, স্বচ্ছতা এবং নিয়ন্ত্রণÑ এ চারটি ভিত্তি নিশ্চিত না হলে ‘টেস্ট-সন্ত্রাস’ দূর করা সম্ভব নয়।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, মানুষের ভরসাকে বাঁচানো। স্বাস্থ্যসেবার মূল কেন্দ্রে থাকা উচিত রোগীর স্বার্থ, কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নয়। মানুষের জীবনকে মুনাফার পণ্যে পরিণত হওয়ার এই প্রবণতা বন্ধ না হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণরূপে বাণিজ্যিকতার দখলে চলে যাবে। স্বাস্থ্যসেবায় আস্থা ফিরিয়ে আনতে, মানবিক চিকিৎসা পুনরুদ্ধার করতে টেস্ট-সন্ত্রাস এখনই বন্ধ করতে হবে।