সোমবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


ড. মাহরফ চৌধুরী

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৭, ২০২৫, ০১:৩১ এএম

বাংলাদেশি উত্তরাধিকার

প্রবাস-জীবন ও আমাদের সংস্কৃতি

ড. মাহরফ চৌধুরী

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৭, ২০২৫, ০১:৩১ এএম

প্রবাস-জীবন ও আমাদের সংস্কৃতি

প্রবাস-জীবন নিয়ে মানুষের নানামাত্রিক কৌতূহল আর চিন্তা-ভাবনার শেষ নেই। অন্তহীন এই জিজ্ঞাসায় ব্যক্তিক-মানুষের জাতিগত উত্তরাধিকার ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তাই একটি নতুন দেশের সাংস্কৃতিক আবহে নবাগত মানুষের স্বপ্নের প্রজাপতিরা ডানা মেলতে শুরু করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য যে, আমরা বাংলাদেশিরা স্বপ্নের সেই প্রজাপতিগুলোকে ব্যক্তিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র গ-িতে আবদ্ধ করে ফেলি। বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের যে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রয়েছে তার বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা কি আমাদের নেই? এ প্রশ্ন তাই আমাকে প্রতিনিয়তই আন্দোলিত করেছে এবং করছে এই প্রবাস-জীবনে। আমাদের জ্ঞান, জীবনাভিজ্ঞতা আর এ প্রবাসের ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিম-ল কি আমাদের জ্ঞান-জগতে আলোড়ন তুলতে সক্ষম নয়? নতুন পরিবেশে নবজীবনের স্বপ্নের ক্যানভাসে মানবিকতার তুলির পরশে আমরা কি কিছুটা বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে পারি না? পারি না সমৃদ্ধ করতে আমাদের মন ও মননকে?

স্বদেশে ফিরে প্রবাসীদের অনেকেই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় প্রবাস-জীবন নিয়ে নষ্টালজিক আমেজে নানা বিচিত্র কাহিনি তুলে ধরে আশপাশের লোকজনদের কাছে। বাস্তব আর অবাস্তবের অদ্ভুত সংমিশ্রণে সেসব জীবনগাঁথা সাফল্য আর গৌরবের বহুবর্ণিল আলোকচ্ছটায় দীপ্ত হয়ে ওঠে। আর সেসব মানুষেরাই আবার প্রবাসে বসে প্রবাসী স্বদেশিদের কাছে কল্পলোকের গল্প বলে স্বদেশে নিজের অবস্থা এবং অবস্থান নিয়ে। নিজেদের জাহির করার কসরত করতে গিয়ে বিদেশের মাটিতে পা রেখেই এ শ্রেণির বাংলাদেশিদের বেশির ভাগই নবাবজাদা কিংবা শাহজাদা হয়ে পড়ে। হয়ে পড়ে এক একজন দিকপাল কিংবা নিধেনপক্ষে ঔপনিবেশিক সামন্ত জমিদারের উত্তরপুরুষ। আপন মহিমা বিস্তারে ও আত্মপ্রতিষ্ঠায় পরিতৃপ্তি লাভ করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু এসব মানুষদের অকর্ষিত চিত্তের প্রক্ষেপণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে মহিমা কীর্তন এমন নগ্ন আর অন্তঃসারশূন্যতায় পর্যবসিত হয় যে তা তাদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক সৌন্দর্য আর সৌকর্ষকে ম্লান করে দেয়। পরিশীলিত আত্ম-প্রচারে দোষের কিছু না থাকলেও এ সুপেরিয়টি-ইনপেরিয়রিটি কমেপ্লক্স সঞ্জাত অন্ধ আত্মমুখী প্রবণতা যে আমাদের সৌহার্দ, সম্প্রতি আর ঐক্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রবাসের ব্যক্তিক-দ্বন্দ্ব আর গোষ্ঠীবদ্ধ জটলা তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একটি গণতান্ত্রিক সহনশীল উদার পরিবেশে বসবাস করেও নিজেদের ব্যক্তিচরিত্র আর সামষ্টিক কল্যাণ নিয়ে ভাববার সময় কি আমাদের কখনোই হবে না?

প্রবাসে যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ছেন কিংবা নিজ নিজ ফিল্ডে কাজ করছেন, তারা যে যার ক্ষেত্রে যোগ্যতমদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন তাতে কারো কারো সন্দেহ থাকলেও আমার মতো ক্ষুদ্রজ্ঞানের সাধারণ মানুষদের থাকার কথা নয়। ধানের সঙ্গে চিটার অস্তিত্বকে যেমন অস্বীকার করা যায় না, তেমনি আমার মতো দুএকটা চিটা হয়তো তাদের দলে ঢুকে পড়তে পারেন কোনো এক কানাগলি দিয়ে।

মানুষ হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে যদি আমরা স্বীকার করি, তবে আমরা কেউই দুধে ধোয়া তুলসীপাতা নই। ব্যক্তিক দোষ-ত্রুটি আর সীমাবদ্ধতা নিয়েই আমরা এক একজন মানুষ। প্রবাসের এ স্বল্পকালীন জীবনযাত্রায় অনেক গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল-এর সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই কমবেশি হয়েছে। তাদের সঙ্গে মেলামেশার সেই অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে তাদের মানসিক ক্লেদাক্ততার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেও জীবনবাস্তবতা সম্পর্কে তারা আমার জ্ঞানজগতকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে; করেছে আলোকিত নতুন মাত্রায়। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ যে তারা আমাকে মানুষের মনোজাগতিক অভিজ্ঞানের অস্পষ্ট ও স্পর্শকাতর দিকগুলো সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ভিন্নসাংস্কৃতিক পরিম-লে বিচ্ছিন্নভাবে স্বদেশিদের ব্যক্তিচরিত্রের স্বরূপ অনুধাবণ করা যত সহজ, তত সহজ নয় নিজ দেশে নিজ প্রতিবেশে অবস্থান করে। কারণ সমসাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়েও ভিন্নসাংস্কৃতিক পরিম-লে আবেগহীন অভ্যাস আর অভ্যাসহীন আবেগÑ এ দুয়ের আপেক্ষিক মানদ- একজন মানুষের ব্যক্তিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে সুস্পষ্ট করে তোলে আমাদের বোধের জগতে। এখানে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের কারো সঙ্গেই আমার পূর্ব-পরিচয় ছিল না এদেশে আসার আগে। তাই সম্পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতহীনভাবে ব্যক্তিক আদর্শের পরিমাপে তাদের জানার সুযোগ হয়েছে। না, এখানে কোনো ব্যক্তি-মানুষ ও তার ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে বিষাদাগার করার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। জাতি হিসেবে আমাদের নিজেদের দুর্বলতার দিকগুলো আলোচনার প্রসঙ্গে দুএকটা প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে অনিবার্যভাবেই আমাদের উপলব্ধির জগতকে শাণিত করার জন্য। তাতে যদি কেউ কোনোভাবেই অস্বস্তিবোধ করেন আমার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশে তবে সেটা একান্তই আমার ভাষাগত প্রকাশভঙ্গির ব্যর্থতা।

মূলধারার জনজীবন বিচ্ছিন্ন এ প্রবাসে বসেও নির্লজ্জভাবে আমরা যেভাবে নিজেদের মহিমা প্রচার করি স্বদেশি-প্রবাসীদের কাছে, সেভাবে কেন স্বদেশ ও স্বজাতির মহিমা কীর্তন করি না বিদেশিদের কাছে? আমাদের মধ্যে এক ধরনের প্রবণতা লক্ষণীয় যে আমরা আমাদের জাতীয় দীনতাকে বিদেশিদের কাছে তুলে ধরে এক প্রকার আত্মতৃপ্তি লাভ করার চেষ্টা করি। নিজের জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করা আর নিজেদেরকেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা যে একই কথা সেটা না বোঝার মতো নির্বোধ তো আমরা কেউ নই। তবে কেন এ আত্মহনন? সত্যিই আমরা এক আত্মঘাতী জাতি। নিজেদের গোবরে পদ্মফুল ভাবার আত্মতুষ্টি কি শতদলে বিকশিত বনফুলের মহিমান্বিত আত্মবিকাশের আনন্দের চেয়ে বড় হতে পারে? এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার সময় কি আমাদের হবে না কোনো দিন?

যে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারজাত মানসিক-দৈন্য আমাদের প্রপীড়িত করে চলেছে, দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়কে- সেটা আরও প্রকোট করে তুলেছে আমাদের ব্যক্তিক ক্ষুদ্রতাকে। স্বদেশের নোংরা রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি আর ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রবণতা যে সাংস্কৃতিক দারিদ্র্যের জন্ম দিয়েছে আমাদের মাঝে তারই প্রতিনিধিত্ব করে চলেছি আমরা। এ প্রবাসেও তাই আমরা বিভাজিত নানা পরিচয়ে আমাদের আপন পরিচিতির বলয়ে। সে পরিচয় কখনো আদর্শিক অবস্থানজাত, রাজনৈতিক চেতনাগত, কখনো বা আরোপিত- ব্যক্তিক-দ্বন্দ্বের ভিত্তিভূমে যার শিকড় প্রোথিত। অন্যকে ছোট করতে পরলেই যেন নিজকে বড় করা গেলÑ এ ধরনের একটা বিশ্বাস ও প্রবণতা আমাদের অনেকের মাঝে লক্ষণীয়। অন্যকে আহত করার পৈশাচিক আনন্দে অনেককেই মেতে ওঠতে দেখি। ফলে ব্যক্তিক আদর্শে অবিচল থেকে অন্যের সঙ্গে সহমর্মিতায় সহাবস্থান আমাদের আচরণে নেই। আদর্শিক জীবনচর্যায় আত্মশক্তির বিকাশের মধ্যে দিয়ে নিজেকে বড় করে তোলার প্রবণতা আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। তাই বিশাল বিশ্বের একটা ক্ষুদ্র গ-িতে আবদ্ধ হয়ে আমরা ছোট হতে হতে এতোই ছোট হয়ে পড়েছি যে, আমাদের দীনতা এখন আর নিজেদের চোখে ধরা পড়ছে না। নানা পরিচয়ে আমরা আমাদের শতধা বিভক্ত করলেও এদেশবাসী কিংবা অন্য বিদেশিদের কাছে আমাদের একটাই পরিচয় আমরা বাংলাদেশি। আমাদের প্রবাসীদের কাছেও আমাদের বাংলাদেশি পরিচয়টাই যেন প্রধান হয়ে ওঠে আর সব বিভেদ ভুলে সবাই মিলে স্বদেশ ও স্বজাতিকে মহিমান্বিত করে তুলতে পারি এ প্রবাসেÑ এটাই হোক আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ সংকল্প আর সকল প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দ্।ু

লেখক : ড. মাহরফ চৌধুরী, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!