উত্তম কুমার। বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রের মহানায়ক। কালের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি হয়েছেন বহু প্রজন্মের আদর্শ। তাই তো তিন যুগ আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তাকে এখনও সমান শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করেন সবাই।
উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি এই অভিনেতা নীতিন বসু পরিচালিত ‘দৃষ্টিদান’ সিনেমায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রে। এরপর সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটিবদ্ধ হয়ে বদলে দিয়েছেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতিধারা।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে ছিল উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনের একচেটিয়া আধিপত্য। এখনও ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল জুটি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় উত্তম-সুচিত্রাকে। এ জুটি এখনও আলোচিত হয় মানুষের মুখে মুখে।
চলচ্চিত্রে অভিনয় করে উত্তম কুমার কিংবা সুচিত্রা সেনের মতো জনপ্রিয়তা এ উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে খুব কম শিল্পীই অর্জন করতে পেরেছেন। উত্তম কুমার মঞ্চেরও সফল অভিনেতা ছিলেন। তবে চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবেই তিনি পরিচিতি পেয়েছেন।
এ মহানায়ক হয়ত জানতেন, তিনি উত্তম হবেন। তাই নামটা অরুণ কুমার থেকে নিজেই বদলে উত্তম কুমার রেখেছিলেন। ১৯৪৭ সালে উত্তম কুমার ‘মায়াডোর’ সিনেমায় অভিনয় করলেন। কিন্তু সেই সিনেমায় তিনি স্রেফ এক্সট্রা। ১৯৪৮ সালে করলেন ‘দৃষ্টিদান’, এখানে তিনি নায়ক অসিত বরণের কিশোরকালের অভিনয় করলেন।
১৯৪৯ সালে ‘কামনা’ সিনেমায় তিনি নায়ক হলেন, নায়িকা ছিলেন ছবি রায়। এরপর আট বছরে আটটি সিনেমা করেন। সবগুলোই সুপার ফ্লপ। তার নাম হয়ে গেল ‘ফ্লপমাস্টার’। ১৯৫৪ সালে শুরু হলো উত্তম যুগ।
তার ভুবন ভোলানো হাসি, অকৃত্রিম রোমান্টিক চোখের দৃষ্টি আর অতুলনীয় অভিনয়ের গুণে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়েও বাঙালি দর্শকদের হৃদয়ের মণিকোঠায় তিনি মহানায়ক। ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ দিয়ে শুরু আর ১৯৮০ সালে এসে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ সিনেমায় অভিনয় করার সময় জীবনাবসান।
মাত্র ৫৪ বছরের ক্ষণজন্মা কিংবদন্তি অভিনেতা উত্তম কুমার চলচ্চিত্র শিল্পকে দিয়েছেন ৩২ বছর। তবুও অতৃপ্তি মেটে না। তার চলে যাওয়া ছিল বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের আলোকবর্তিকার মৃত্যু। তিনবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এ অভিনেতা সম্পর্কে যতই বলা হোক না কেন তা কম হবে।
উত্তম কুমার ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। অভিনয় জগতে আসার পেছনে তার পরিবারের প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃতিমনা উত্তমের বাপ-চাচারা পাড়া-প্রতিবেশীর সহায়তায় গড়ে তুলেছিলেন ‘সুহৃদ সমাজ’।
উত্তমের মাথায় চেপে বসল সিনেমার ভূত। যে করেই হোক সিনেমায় অভিনয় করতে হবে। তখনকার দিনে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সঙ্গে গান জানা অপরিহার্য ছিল। নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি ১৯৪৫ সালে বিকম পাস করেন। উত্তমের মাথা থেকে অভিনয়ের ভূত তখনো নামেনি। সুযোগ পান ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয়ের।
পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি দৈনিক এক টাকা চার আনা করে সম্মানী পান। কিন্তু তার প্রথম অভিনীত সিনেমা পরবর্তী সময়ে আর মুক্তি পায়নি। ১৯৪৮ সালে মাত্র সাতাশ টাকা পারিশ্রমিকে নীতিন বসুর ‘দৃষ্টিদান’ সিনেমায় উত্তম কুমার নায়কের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেন। এটিই তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম কোনো সিনেমা। কিন্তু তার অভিনীত প্রথমদিকের সিনেমাগুলো চরমভাবে ব্যর্থ হয়।
তার ভাগ্য খুলে দেয় ‘বসু পরিবার’ সিনেমাটি। এই সিনেমাটি ব্যবসাসফল হওয়ার পাশাপাশি দর্শক, সমালোচক ও মিডিয়া মুখরিত হয় তার প্রশংসায়। প্রচুর কাজের প্রস্তাব পেতে থাকেন তিনি। শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদুস্তুর অভিনেতা বনে যান। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমার মধ্য দিয়ে উত্তম-সুচিত্রা প্রথম জুটি বাঁধলেন। পরবর্তী সময়ে উত্তম সুচিত্রা জুটি বাংলা সিনেমার সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমা মুক্তির পর প্রমাণিত হলো বাংলা সিনেমার অপ্রতিদ্বন্দ্বী জুটি উত্তম-সুচিত্রা।
অভিনয় পাগল উত্তম কুমার চলচ্চিত্রের সঙ্গে সঙ্গে সমানতালে মঞ্চেও কাজ করেন। স্টার থিয়েটারে এক নাগাড়ে ‘শ্যামলী’ নাটকের ৪৮৬টি প্রদর্শনীতে তিনি অভিনয় করেন। ১৯৫৬ সালে উত্তম কুমার অভিনেতা থেকে প্রযোজক হয়ে ‘হারানো সুর’ চলচ্চিত্রটি উপহার দেন। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র তিনি পরিচালনাও করেছেন। গুটিকয়েক হিন্দি সিনেমাতেও কাজ করেছেন তিনি। ১৯৮০ সালের আজকের দিনে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ সিনেমার শুটিং চলাকালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হন।
আপনার মতামত লিখুন :