স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার বছর না পেরোতেই আবারও পানিতে ডুবে গেছে ফেনীর জনপদ। টানা বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার পাঁচটি উপজেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল ও নদী-তীরবর্তী এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। ৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া প্রবল স্রোতে ভেঙে যায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪১টি অংশ। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষি, অবকাঠামো, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে।
জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বন্যায় ফেনীতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩৮ কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৩১ টাকা। এতে কৃষি খাতে ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ২ হাজার ৭২৫ দশমিক ৬ হেক্টর জমির ফসল ও বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। কৃষকদের ভাষ্যমতে, প্রতিবছর একইভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
মাছ চাষিদের কষ্টও কম নয়। বন্যার পানিতে ৪৪০ দশমিক ১০ হেক্টর হ্যাচারি এবং ১ হাজার ৬৭৭টি পুকুর-জলাশয় ভেসে গেছে। প্রাণিসম্পদ খাতেও ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় ৬৬ হাজার ৮২৫টি প্রাণী মারা গেছে বা ভেসে গেছে, যার মধ্যে রয়েছে গরু, ছাগল, ভেড়া ও লক্ষাধিক মুরগি।
বন্যার প্রবল স্রোতে জেলার ৩১৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা ও আধাপাকা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এলজিইডি ও সড়ক বিভাগ জানিয়েছে, অন্তত ৬১টি ব্রিজ ও কালভার্ট ভেঙে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, এবার জেলায় ৪৩ দশমিক ৩৭৩ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙেছে। যা আগামী মৌসুমের জন্য আরও বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসা। ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা। ক্ষতির মুখে পড়েছে ১৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বন্যায় নষ্ট হয়েছে কয়েক হাজার নলকূপ ও টয়লেট। বন বিভাগ জানিয়েছে, ৩৯ দশমিক ৫ হেক্টর বনায়ন ও আট হাজারের বেশি নার্সারি ভেসে গেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৫ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইন।
বন্যাকবলিত ফুলগাজীর মুন্সিরহাট এলাকার বাসিন্দা আলী আহম্মদ বলেন, ‘ঘরের জিনিসপত্রের সঙ্গে পুকুরও ভেসে গেছে। বছর বছর একইভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছি। এখানে টেকসই বাঁধ না হলে দুর্ভোগ থেকে মুক্তি নেই।’ মো. নিষাদ নামের এক তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, ‘এখন ভারী বৃষ্টি না হলেও ভারতের উজানের পানিতে ভেসে যাচ্ছি। নদীর নাব্য সংকট, আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার দায়সারা কাজের কারণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মাহবুব আলম জানান, সব ধরনের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির জন্য বরাদ্দ এলে পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু হবে। আংশিক ক্ষয়ক্ষতির ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এনজিও ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে পুনর্বাসনে কাজ চলবে বলে জানান তিনি।
এর আগে গত বছরের জুলাই-আগস্টে ফেনী জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। বিশেষ করে ১৯ আগস্ট শুরু হওয়া বন্যায় প্রাণ হারিয়েছিল ২৯ জন। ক্ষতি হয়েছিল ঘরবাড়ি, সড়ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যানবাহন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সব খাতে। এক বছরের ব্যবধানে আবারও সেই ভয়াবহ স্মৃতি ফিরেছে ফেনীবাসীর জীবনে।
স্থানীয়দের একটাই দাবি, এই দুর্ভোগের চক্র থেকে তারা মুক্তি চায়। প্রয়োজন দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর বন্যা প্রতিরোধ ব্যবস্থা, নয়তো প্রতি বছরই নতুন করে শুরু হবে ক্ষতির হিসাব আর অসহায় কান্না।
আপনার মতামত লিখুন :