জনবলসহ নানা সংকটে নিজেই রোগী লক্ষ্মীপুরের রায়পুর ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ৯৮টি পদ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। পাশাপাশি আধুনিক সব সরঞ্জামসহ সুসজ্জিত অস্ত্রোপচার কক্ষ থাকলেও হাসপাতালটিতে দীর্ঘ তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে অপারেশন থিয়েটার। চিকিৎসক ও জ্বালানি সংকটের জেরেই হাসপাতালটিতে অস্ত্রোপচার করা যাচ্ছে না জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ কারণে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না। জরুরি ও প্রয়োজনীয় সেবা না পেয়ে রোগীদের বেশি টাকা খরচ করে উপজেলা ও জেলা শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অস্ত্রোপচার করাতে হচ্ছে। এতে বিপাকে পড়েছেন উপজেলাবাসী।
রায়পুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রায়পুর পৌরসভার দেনায়েতপুর এলাকায় স্থাপিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করেন। গত ২০ বছর জনবলসংকটের মধ্য দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে হাসপাতালটির স্বাস্থ্যসেবা। উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের প্রায় চার লাখ মানুষ এখান থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অস্ত্রোপচার বন্ধ থাকা এবং চিকিৎসকসহ জনবলসংকটে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রসূতিদের অস্ত্রোপচারের জন্য একজন গাইনি সার্জনসহ জনবল খুবই প্রয়োজন। হাসপাতালে অবেদনবিদ থাকলেও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। প্রায় দুই বছর আগে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির নামে একটি প্রকল্পের অধীনে বিশাল একটি জেনারেটরসহ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি সরবরাহ হলেও তা ব্যবহার না করায় অচল হয়ে পড়ে আছে। এতে নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রপাতি। অন্যদিকে অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালটিতে সার্জারি-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক, নার্স, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীসহ মোট পদ রয়েছে ২০৩টি। এর মধ্যে ৯৭টি পদ শূন্য। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৩১টি। এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ১৮ জন। চিকিৎসা কর্মকর্তাদের ৮টি পদের ৪টি শূন্য। জুনিয়র কনসালট্যান্টের ১০টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৫ জন। বিশেষজ্ঞের পদে কোনো চিকিৎসক নেই। একজন নারী ডেন্টাল সার্জন আছেন। হাসপাতালে প্রতিদিন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু রোগী চিকিৎসা নিতে এলেও শিশু চিকিৎসক আছেন মাত্র দুজন। অর্থোপেডিক, চক্ষু, চর্ম ও যৌন, নাক, কান, গলা, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো সৃষ্টি করা হলেও পদায়ন করা হচ্ছে না। এ ছাড়া হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স ৩০ জনের মধ্যে আছেন ১৫ জন। ওয়ার্ডবয়, আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ২৪টি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ১১ জন।
এদিকে চারটি কোয়ার্টার ভবন থাকলেও ঝুঁকিপপূর্ণ ও বৃষ্টির পানি পড়ায় সেখানে কোনো চিকিৎসক থাকেন না। হাসপাতালটিতে ২০০৭ সালে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) চালু হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব ধরনের অস্ত্রোপচারই চালু ছিল। এরপর তিন বছর ধরে চালুর উদ্যোগ নিলেও জেনারেটর ও লোকবলের কারণে অস্ত্রোপচার হচ্ছে না। শুধু অবেদনবিদ ইয়াসিন মাহমুদ দায়িত্ব পালন করছেন। গত তিন বছর জেনারেটর থাকলেও তা অকেজো থাকায় অস্ত্রোপচার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে মাঝে মাঝে অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। জ্বালানি তেলের বরাদ্দ না থাকায় বিদ্যুৎ চলে গেলে মোমবাতির সাহায্যে চলে অন্ত্রোপচার।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ১৮ হাজার ৪৪৫ জন রোগী বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১২ হাজার ৮৮১ জন নারী এবং ৬ হাজার ৯৪৯ জন শিশু রোগী; অর্থাৎ মাসে গড়ে এখানে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার রোগী বহির্বিভাগে সেবা নেন। গত জুলাই মাসে দিনে গড়ে ৫৪ রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে এবং রোগীদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন সমস্যার কথা জানা যায়। হাসপাতালটিতে একটি পুরোনো দ্বিতল ভবন ও একটি নতুন দোতলা ভবন আছে। পুরোনো দ্বিতল ভবনটিতে রোগী রাখার ব্যবস্থা থাকলেও মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হয়। প্রশাসনিক ভবনে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয়, ফার্মেসি ও সম্মেলন কক্ষ করা হয়েছে। চিকিৎসা নেওয়ার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কক্ষের সামনে রোগীর দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাইরে বারান্দাতেও শয্যা পাতা হয়েছে। হাসপাতালের অস্ত্রোপচারের কক্ষটি তালাবদ্ধ। পরে ওটি ইনচার্জ সিনিয়র স্টাফ নার্সের সহযোগিতায় তালা খোলা হয়। কক্ষে দিয়ে দেখা যায়, সেখানে অস্ত্রোপচারের জন্য সব সরঞ্জাম রয়েছে। নতুন ভবনের দ্বিতীয়তলায় পোস্ট অপারেটিভ কক্ষটিও সুসজ্জিত রাখা। তবে হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের কোনো ব্যবস্থা নেই।
তানভীর হাসান নামের একজন বলেন, এ হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের আন্তরিকতার কমতি না থাকলেও চিকিৎসক ও জনবলসংকটের কারণে তারা রোগীদের কাক্সিক্ষত সেবা দিতে পারছেন না। এ ছাড়া রয়েছে হাসপাতালগুলোর দালালদের দৌরাত্ম্য। হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশসহ নানা সমস্যার কারণে রোগীদের ফুসলিয়ে বিভিন্ন প্রাইভেট হসপিটালে নিয়ে যান দালালরা।
স্থানীয় বাসিন্দা অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ফরিদগঞ্জ উপজেলার কাছাকাছি হয় ফরিদগঞ্জের রোগীও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। হাসপাতালের সমস্যা দূর করা গেলে সব রোগীকেই সু-চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হতো। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির সমস্যা দ্রুত সমাধানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।
জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বাহারুল আলম বলেন, ‘অস্ত্রোপচার কক্ষ চালু করতে পারলে মানুষ উপকৃত হতো। অবেদনবিদ থাকায় অস্ত্রোপচার কক্ষ চালু করেছিলাম। তবে গত দুই বছর ধরে তা বন্ধ রয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে তা চালু করা হয়। জনবলসংকটের বিষয়টি প্রতি মাসের প্রতিবেদনেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না৷’