যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে দালালের দৌরাত্ম্য কমছে না। যেখানে রোগী, সেখানেই হাজির হচ্ছে দালাল। তাদের খপ্পরে পড়ে অনেক রোগী সরকারি সেবা বাদ দিয়ে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বাধ্য হচ্ছে। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় ও নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে রোগী ও স্বজনেরা। অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতালের কিছু কর্মচারী, ক্লিনিক-মালিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে এ দালালরা হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারের সামনে জড়ো হয়, এরপর ছড়িয়ে পড়ে পুরো হাসপাতালে। ৫০ শতাংশ কমিশনের লোভে সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নিচ্ছে তারা।
সূত্রে জানা গেছে, সরকারি এ হাসপাতালে দালালের দৌরাত্ম্য দীর্ঘদিন থেকেই। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ওষুধ ফামের্সির অর্ধশত দালাল হাসপাতালের বিভিন্ন কোনে অবস্থান নিয়ে জমপেশ প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত দিনে ডা. আবুল কালাম আজাদ লিটু এ হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকেই দালালদের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করে। দালালদের কবল থেকে রোগী ও স্বজনদের রক্ষা করতে তার নির্দেশনায় হাসপাতালের বিভিন্ন কোণে ১০টি প্রচার মাইক বসানো হয়েছিল। এ ছাড়া টিকিট কাউন্টারের সামনে স্থাপন হয় তথ্যকেন্দ্র। মাইকগুলোয় প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত দালালবিরোধী প্রচার চালানো হতো। তথ্যকেন্দ্রে একজন কর্মচারী রোগীদের সব ধরনের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করতেন। যাতে দালালরা মানুষকে বোকা বানিয়ে প্রতারণার সুযোগ না পায়। কিন্তু বর্তমানে মাইকগুলো আর বাজে না। তথ্যকেন্দ্রে হাসপাতালের কোনো কর্মচারী দায়িত্ব পালন করেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাদের মধ্যে অনেকেই রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে বিগত দিনে পুলিশের কাছে আটক হয়েছে। পরে ছাড়া পেয়ে আবারও তারা দালালিতে নেমে পড়েছে। তাদের কাজ হলো সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে বাইরে নিয়ে কমিশনে বিক্রি করা। অভিযোগ উঠেছে, তাদের সঙ্গে সখ্য রয়েছে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারীর। তারা সময়মতো পেয়ে যাচ্ছে ভাগের টাকা। আবার কিছু সরকারি কর্মচারী নিজেরা দালালির সঙ্গে জড়িত।
যশোর সদর উপজেলার চান্দুটিয়া গ্রামের জসিম উদ্দিন জানান, গত ২১ আগস্ট তার ৪ বছরের ছেলেকে ডাক্তার দেখানোর জন্য সদর হাসপাতালে যান। টিকিট কাউন্টারের সামনে যেতেই তিনি একজন দালালের খপ্পরে পড়েন। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ভালোভাবে রোগী দেখেন না। এখানকার মেশিনও নষ্ট। আমার সঙ্গে ক্লিনিকে চলেন অল্প টাকায় বড় ডাক্তার দেখিয়ে দেব। দালালের খপ্পরে পড়েছেন বুঝতে পেরে তিনি সেখান থেকে সরে আসেন। সরকারি হাসপাতাল থেকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফেরেন।
সূত্র জানায়, কতিপয় চিকিৎসকের পোষ্য দালাল আছে। কমিশন লোভে চিকিৎসকরা রোগীকে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তারা ব্যবস্থাপত্রে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখে কোথা থেকে করতে হবে, সেই প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে বলে দেন। ওই প্রতিষ্ঠানের দালাল অপেক্ষায় থাকে চিকিৎসকের কক্ষের সামনে। অন্যথায় রোগীকে সহকারীর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। দালালরা রোগীকে নির্দিষ্ট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। অথবা চিকিৎসকের সহকারী ওই প্রতিষ্ঠানের কার্ড ধরিয়ে পাঠিয়ে দেন। প্রতিষ্ঠান মালিক চিকিৎসক ও দালালের কমিশন আলাদা হিসেবে পরিশোধ করে থাকেন। কিন্তু দালালরা নিজেদের যোগ্যতায় রোগী ভাগিয়ে আনতে পারলে শতকরা ৫০ ভাগ কমিশন পান। সে বহিরাগত দালাল হোক আর হাসপাতালের কর্মচারী দালাল হোক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে এক্স-রে ২০০ টাকা, ইসিজি ৮০, আলট্রাসনো ১১০ টাকা খরচ হয়। অথচ বেরসরকারি হাসপাতাল অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রায় তিনগুণ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রস্রাব ও রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো আছেই। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে রোগীরা দালালের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরছে।
এ ব্যাপারে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হুসাইন শাফায়াত জানান, দালালের দৌরাত্ম্য কমানো একটা মিশন। ফলে দালালদের বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জোরালো অবস্থানে রয়েছে। দালাল সিন্ডিকেটের বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হবে।