****নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ
*** ইজারা ছাড়াই ঘাট থেকে তোলা হচ্ছে চাঁদা
*** ভাগ যায় রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের পকেটে
*** অভিযোগ না থাকায় ব্যবস্থা নিতে পারছি না : উপজেলা প্রশাসন
*** ঘাটের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে গেল বছরের খুন হয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও যুবদল নেতা
*** আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের শংকা স্থানীদের
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের দক্ষিণাঞ্চলের চরএলাহী ঘাটকে ঘিরে চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, দখল-বেদখল আর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অস্থির হয়ে উঠেছে জনজীবন। হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ইজারা ছাড়াই রাজনৈতিক নেতাদের মদত ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে ঘাটের নিয়ন্ত্রণ যুদ্ধ। লিখিত অভিযোগ কিংবা কেউ মুখ না খোলায় ব্যবস্থা নিতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
সরেজমিনে জানা যায়, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে উড়ির চর ও চট্টগ্রামের স্বন্দ্বীপ উপজেলার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম চরএলাহী ঘাট। এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার পণ্য ওঠানামা হয়। মাছ, শাক-সবজি ছাড়াও মাদকের বড় চালান আসা-যাওয়া করারও অভিযোগ এই রুটে। সরকারি বিধি মোতাবেক ঘাটটি ইজারা নিয়েছিল চরএলাহী ইউনিয়ন যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ বেলাল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ঘাটটি নিয়ন্ত্রণে নেয় স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মতিন তোতা। এই ঘাটের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে গেল বছরের ২৭ আগস্ট আবদুল মতিন তোতা এবং পরবর্তীতে যুবদল নেতা এরশাদ মাঝি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে খুন হন। আহত হন ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাহাব উদ্দিন, সাবেক ছাত্রদল নেতা আশ্রাফুল ইসলাম ইমনসহ বিএনপির দুই গ্রুপের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। এরপরও থামেনি সহিংসতা। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, দাঙ্গা, আর লুটতরাজে অতিষ্ঠ স্থানীয়রা।
মাসুম বিল্লাহ, বেলাল হোসেনসহ বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, চরএলাহী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোতা হত্যার পর এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষ এই হত্যার বিচার চাইলেও তার ছেলে ইসমাইল তোতা, ইব্রাহিম তোতাসহ অন্যান্য ছেলেরা হত্যা মামলার প্রকৃত আসামিদের আড়ালে রেখে বিএনপির নেতাদের আসামি করে এই এলাকায় বিএনপির রাজনীতিকে জিম্মি করে চরএলাহী ঘাট দখল করে লাখ লাখ টাকা লুটে নিচ্ছে। চরএলাহী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের শত শত একরের প্রজেক্ট রয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর তারা ওইসব প্রজেক্ট দখল করার হুমকি দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেছে। শুধু তাই নয়, তোতা চেয়ারম্যানের ছেলেরা এই চরএলাহীতে বালু মহালের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। এক কথায় বলা যায় চরএলাহী হলো টাকার কুমির। এই টাকার কুমির নিয়ন্ত্রণে নিতে চরএলাহীকে অস্থির এলাকাতে পরিনত করা হয়েছে।
স্থানীয়রা বলেন, তোতা চেয়ারম্যানের ছেলেদের এসব চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী ও অপকর্মের প্রতিবাদ করায় তারা ইতোমধ্যে চরএলাহী ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাহাব উদ্দিন, ছাত্রদল নেতা আশ্রাফুল ইসলাম ইমন, বিএনপি কর্মী বেলাল হোসেনসহ অসংখ্য বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়ে আহত করেছে। এক কথায় তোতা চেয়ারম্যানের পরিবারের কাছে পুরো চরএলাহী ইউনিয়নের জনগন জিম্মি হয়ে আছে।
চরএলাহী ইউনিয়নে ঘাট দখল, চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসীর বিষয়ে বিব্রত বিএনপি নেতারাও। সাম্প্রতিক উপজেলার বসুরহাট বাজারে এক সংবাদ সম্মেলন বসুরহাট পৌর বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল মতিন লিটন বলেন, চরএলাহী ঘাট আগে নিয়ন্ত্রণ করতো আওয়ামী লীগের রাজ্জাক চেয়ারম্যান, এখন নিয়ন্ত্রণ করছে তোতা চেয়ারম্যানের ছেলেরা। তিনি বলেন, সারা কোম্পানীগঞ্জে যত প্রজেক্ট আছে, ওই চরএলাহীতে তার চেয়ে বেশি প্রজেক্ট আছে। প্রজেক্টের মালিকদের জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়। চরএলাহীকে তারা জিম্মি করে রেখেছে। আমরা চাই সরকারিভাবে যেন চরএলাহী ঘাট পরিচালনা করা হয়। সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রশাসনের প্রতি আহব্বান জানান এই নেতা।
এদিকে, ঘাট দখল, চাঁদাবাজির বিষয় নিয়ে চরএলাহী ঘাটের কেরানি সেলিম, ওই ঘাটের স্পিট বোট মালিক ইস্কান্দার মির্জা ও স্থানীয় কথিত সাংবাদিক কামালের দুটি বিষ্ফোরক কল রেকর্ড (অডিও) ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। যাহা ‘টক অব দ্যা নোয়াখালীতে’ পরিণত হয়েছে। ওই কল রেকর্ডে বলা হয়েছে, ঘাটটিতে প্রতিটি স্পিট বোট চালাতে তোতা পরিবারকে ২০% চাঁদা দেওয়া লাগে। ওই চাঁদার ভাগ যায় ইউনিয়ন ও উপজেলা বিএনপি নেতা এবং স্থানীয় ইউএনও ও ওসির পকেটে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইসমাইল তোতার মুঠোফোনে কল দিয়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া দেননি। যার কারণে তার মন্তব্য জানা যায়নি।
এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, ঘাট নিয়ে সীমানা জটিলতার একটা মামলা হওয়ায় ঘাটটি ইজারা দেওয়া হয়নি এবং খাস কালেকশানও হয়নি। কিন্তু ঘাটে যে চাঁদাবাজি হচ্ছিল তা নিয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। সাংবাদিকদের কাছ থেকে বিষয়টি জেনে ওখানে একাধিকবার গিয়েছি, তখনও কেউ মুখ খোলেনি। কল রেকর্ডে করা অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে এই কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিকরা এই চাঁদাবাজি করছিল কিন্তু তাদের মধ্যে মতের মিল না হওয়ায় বিষয়টি এখন প্রকাশ্যে এসেছে। বর্তমানে ঘাটটি উপজেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
চরএলাহী ঘাটে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে যে সহিংস পরিস্থিতি চলছে, তা স্থানীয় জনজীবনকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করেছে। তবে রাজনৈতিক প্রভাব আর প্রশাসনের নীরবতার মধ্যে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, এই অস্থিরতা কবে থামবে?
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন