*** বরাদ্দ পেলেই উৎপাদন
*** স্বপ্ন দেখছেন কৃষক-শ্রমিক
*** পাল্টে যাবে এলাকার দৃশ্যপট
*** দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর অর্থ বরাদ্দ পেলেই শুরু হবে উৎপাদন
*** চালুর ঘোষণার পর থেকেই স্বপ্ন দেখছেন কৃষক-শ্রমিক
*** চিনিকল বন্ধে বেকার হয়ে যায় কয়েক হাজার শ্রমিক
*** দৈনিক আখ মাড়াইয়ের সক্ষমতা ১ হাজার ১৬ টন
উত্তরের বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান শ্যামপুর চিনিকল ফের জীবন্ত হতে যাচ্ছে। হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা এই মিল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর অর্থ বরাদ্দ পেলেই উৎপাদন শুরু করতে প্রস্তুত। এতে কৃষক-শ্রমিকের হাঁকডাক আর মেশিনের শব্দে প্রাণ ফিরে আসবে চিনিকল এলাকায়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ডিসেম্বরে বন্ধ চিনিকল চালুর ঘোষণার পর এমনটাই স্বপ্ন দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। চিনিকলটি চালু হলে পাল্টে যাবে ওই এলাকার দৃশ্যপট। তবে চিনিকল বন্ধের পর শ্রমিক-কর্মচারীরা একদিকে যেমন কাজ হারান। অন্যদিকে চাষিরাও মুখ ফিরিয়ে নেন আখচাষ থেকে। সময় কম লাগায় আখচাষের পরিবর্তে এখন তারা ধান, গম, ভুট্টা কিংবা সবজি চাষে বেশি আগ্রহী। ফলে চিনিকল উৎপাদনে ফিরলেও চাষিরা আখ উৎপাদনে ফিরবেন কি না সেটি এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
জানা যায়, টানা লোকসানের মুখে ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুম থেকে কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় রংপুরের একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান শ্যামপুর চিনিকলের। সেই থেকে বন্ধ রয়েছে উৎপাদন। এক সময়ের প্রাণচাঞ্চল্যে ঘেরা এই মিলে এখন কেবলই সুনসান নীরবতা। দাপ্তরিক কাজকর্ম চললেও নেই কর্মচাঞ্চল্য, নেই শ্রমিক-চাষিদের আগের মতো হাঁকডাক।
‘ঘোষণার আট মাস পেরিয়ে গেলেও কার্যত কোনো অগ্রগতি নেই। মিলের অবকাঠামো উন্নয়ন, মেশিন মেরামত, নতুন জনবল নিয়োগ এসব সময়ের প্রয়োজন। কবে নাগাদ মিল চালু হবে তা এখনো অনিশ্চিত।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর বন্দরে ১৯৬৪ সালে নির্মাণ হয় শ্যামপুর সুগার মিল। ১১১ দশমিক ৪৫ একর জমির ওপর নির্মিত এই মিলে আনুষ্ঠানিকভাবে মাড়াই শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। দৈনিক আখ মাড়াইয়ের সক্ষমতা রাখা হয় ১ হাজার ১৬ টন। বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয় ১০ হাজার ১৬১ টন। বছরে মিলের মেশিন চালু থাকে তিন মাস।
চালুর পর থেকে লাভের মুখ দেখলেও ২০০০ সালের পর থেকে টানা লোকসানের মুখে পড়ে মিলটি। ব্যাংক ঋণ, ঋণের সুদ ও শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ বিভিন্ন খাত মিলে শেষ পর্যন্ত লোকসান বেড়ে হয় ৫০৫ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন শিল্প, বাণিজ্য, অর্থ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি মিলটির মাড়াই কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে মিলের কার্যক্রম বন্ধ করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন।
মিল এলাকায় আখ উৎপাদন কমে যাওয়া ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে লোকসানের বোঝা বাড়ছে বলে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও তা মানতে নারাজ ছিলেন শ্রমিক-কর্মচারী ও আখচাষিরা।
কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অদক্ষ জনবল ও অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে দাবি করে মিল চালুর দাবিতে আন্দোলন শুরু করে চিনিকল অ্যামপ্লয়িজ ইউনিয়ন ও আখচাষি কল্যাণ সমিতি। তবে শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি সেই আন্দোলন। অব্যাহত লোকসান দেখিয়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় মিলটি।
চিনিকল অ্যামপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান বলেন, শ্যামপুর চিনিকল ঘিরে এই এলাকার শ্রমিক-চাষি মিলে কয়েক হাজার পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হতো।
মিল বন্ধের পর স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন জায়গায় বদলি হলেও বেশির ভাগ অস্থায়ী কর্মচারী কাজ হারিয়েছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বন্ধ চিনিকল চালুর ঘোষণা দেওয়ায় আবার আশায় বুক বেঁধেছেন তারা। আমরা চাই, দ্রুত সময়ের মধ্যে মিলটি যেন চালু করা হয়। আবু সুফিয়ান বলেন, ঘোষণার আট মাস পেরিয়ে গেলেও কার্যত কোনো অগ্রগতি নেই। মিলের অবকাঠামো উন্নয়ন, মেশিন মেরামত, নতুন জনবল নিয়োগ এসব করতে সময়ের প্রয়োজন। কবে নাগাদ মিল চালু হবে তা এখনো অনিশ্চিত।
মিল সূত্রে জানা যায়, কার্যক্রম চালু থাকাকালীন এই মিলে সর্বশেষ ৪৯৩ জন স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। মিলটি বন্ধের পর অনেকেই অবসর গ্রহণ করেছেন এবং কিছু জনবল অন্যান্য মিলে বদলি করা হয়েছে। বর্তমানে শ্যামপুর চিনিকলে ৭২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। জয়পুরহাট চিনিকলের আওতায় (সাব জোন) এবার ২৯১ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছে। মাড়াইয়ের জন্য এখানকার আখ নিয়ে যাওয়া হয় জয়পুরহাট চিনিকলে।
‘মিলটিতে বর্তমানে স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ৭২ জন। তাদের বেতন বকেয়া রয়েছে গত জুন-জুলাইসহ চলতি আগস্ট মাসের। সব মিলিয়ে টাকার পরিমাণ প্রায় ৭০ লাখ। সরকারিভাবে মিল চালুর ঘোষণার পর কর্মপরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হয়েছে। অর্থ ছাড় হলেই মিল চালুর কার্যক্রম শুরু হবে।’
বদরগঞ্জের আখচাষি মনিরুল ইসলাম বলেন, মিল চালু থাকা অবস্থায় নিয়মিত আখচাষ করতাম। এখন আখচাষ বাদ দিয়ে ধান, গম, ভুট্টা, সবজি আবাদ করি। তুলনামূলকভাবে আখের চেয়ে লাভজনক এবং চাষের সময় কম লাগে। এসব ফসলের বাজারজাতকরণ ও মুনাফা দ্রুত হয়, যা চাষিদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। এখন মিল চালু হলে আমার মতো চাষিরা পুনরায় আখ চাষে ফিরবেন কি না সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। এজন্য চাষিদের প্রণোদনার ব্যবস্থাও করতে হতে পারে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী নাজমুল ইসলাম বলেন, কৃষিনির্ভর রংপুরের অন্যতম একটি ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল শ্যামপুর সুগার মিল। এরসঙ্গে জড়িত ছিল কয়েক হাজার পরিবার। এখন কাজ হারিয়ে অনেকে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মিলটি দ্রুত সময়ের মধ্যে চালু করা প্রয়োজন।
২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপনে ছয়টি বন্ধ চিনিকল পুনরায় চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। এরমধ্যে প্রথম পর্যায়ে রংপুরের শ্যামপুর ও দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ চিনিকল রয়েছে। নির্দেশনা অনুসারে দ্বিতীয় পর্যায়ে চালু হবে পঞ্চগড় ও পাবনা চিনিকল এবং তৃতীয় পর্যায়ে কুষ্টিয়া ও রংপুর চিনিকল চালুর কথা বলা হয়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন