সকাল থেকেই লম্বা বাঁশের ডগায় জাল মোড়ানো লাঠি কাঁধে নেয় কয়েকজন মানুষ। কেউ উঠছে পাহাড়ের ঢালে, কেউ ঘন বনের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য একটাই, গাছে গাছে পিঁপড়ার বাসা খুঁজে বের করা, আর সেই বাসা থেকে ডিম সংগ্রহ করা। অসংখ্য পিঁপড়ার কামড়, দংশন, জ্বালা-যন্ত্রণাকে সঙ্গী করেই চলছে তাদের দিনযাপন।
শেরপুরের নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের শতাধিক পরিবার এমনভাবেই সংগ্রহ করে জীবিকার উৎস, পিঁপড়ার ডিম।
নালিতাবাড়ীর সমসচূরা ও রামচন্দ্রকুড়া, ঝিনাইগাতীর বাঁকাকুড়া, গজনি, নয়া রাংটিয়া, বউবাজার ও বটতলা গ্রামজুড়ে এখন এ ডিম সংগ্রহ মৌসুম চলছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান তারা, আর বিকেলের দিকে বসে ‘পিঁপড়ার ডিমের হাট’।
বিশেষ করে রাংটিয়া, বউবাজার ও বটতলা গ্রামের হাটে জড়ো হয় স্থানীয়রা। প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হয় প্রতি কেজি ডিম। একজন সংগ্রাহক দিনে ৪০০ থেকে ৭০০ গ্রাম পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করতে পারেন। এরপর কার্টনে ভরে পাঠানো হয় মহাজনের কাছে। সন্ধ্যায় তালিকা অনুযায়ী সংগ্রাহকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় টাকার খাম।
এই ডিমের প্রধান ক্রেতা বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন এমন শিকারিরা। তাদের কাছে এটি অন্যতম প্রিয় টোপ। মাছ ধরার মৌসুম কিংবা প্রতিযোগিতার সময় চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। স্থানীয় ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন হাট থেকে ডিম কিনে প্যাকেটজাত করি, পরে রাজধানীতে পাঠাই। বর্ষা ও শীত মৌসুমে লাল পিঁপড়ার ডিম বেশি পাওয়া যায়।’
দুই থেকে চারজন মিলে দল গঠন করে কাজ করেন সংগ্রাহকেরা। কেউ লাঠি দিয়ে বাসা নামায়, কেউ ডিম ছাঁকেন। ততক্ষণে অসংখ্য পিঁপড়ার কামড়ে জ্বালায় কাতর তারা। তবু জীবিকার তাগিদে সহ্য করেন সব কষ্ট।
যতীন্দ্র কোচ (৪৫) বলেন, ‘আগে পাহাড়ে প্রচুর ডিম পাওয়া যেত, এখন অনেক কমে গেছে। তবু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খুঁজে বেড়াই, যতটুকু পাই, সেটাই সংসার চালানোর ভরসা।’
পিঁপড়ার ডিম শুধু শিকারিদের টোপ নয়, এটি পাহাড়ি অঞ্চলের অনেক দরিদ্র পরিবারের অর্থনৈতিক ভরসা। অনেকে বছরজুড়ে কাজ পান না, তাই মৌসুমে পিঁপড়ার ডিমই তাদের আয়ের একমাত্র পথ। গারো পাহাড়ের এই মানুষগুলো জানেন, কামড়ের যন্ত্রণা পেরিয়ে যে ডিমের ঝুড়ি ভরে ওঠে, সেটিই তাদের সংসারের হাসি ফোটায়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন