*** সেবা বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ
*** ১৬টি মেডিকেল কর্মকর্তার পদ থাকলেও আছে ৪ জন
অনিয়ম-দুর্নীতি, দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য, চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি ও জনবল সংকটে জর্জরিত হয়ে পড়েছে যশোরের শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও সেবার মানে কোনো উন্নতি হয়নি। ফলে উপজেলার প্রায় চার লাখ মানুষ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা থেকে কার্যত বঞ্চিত হচ্ছেন।
জানা যায়, ১৯৬০ সালে নির্মিত হয় উপজেলার দক্ষিণ বুরুজবাগানে (নাভারন) এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা ও বেনাপোল স্থলবন্দর ও আশপাশের উপজেলার অন্তত চার লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র সরকারি হাসপাতাল এটি। ২০১৫ সালের ৩ মার্চ ৩১ শয্যার হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও সেবার মান বাড়েনি। চিকিৎসক ও জনবল সংকট, ভাঙাচোরা অবকাঠামো আর অনিয়মের কারণে হাসপাতালটি কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে পড়েছে।
জনবল সংকট চরমে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মেডিকেল কর্মকর্তার পদ ১৬টি হলেও কর্মরত মাত্র ৪ জন। কনসালটেন্ট ১০ পদের বিপরীতে আছেন ৪ জন। নার্সের পদ ৩৪ থাকলেও কর্মরত ২৮ জন। স্যাকমো ১৪ পদের বিপরীতে ৭ জন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ৯৪ পদের বিপরীতে ৪৩ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির ২২ পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ৯ জন। পরিচ্ছন্ন কর্মী ও ওয়ার্ড বয় থাকা উচিত ৮ জন, কিন্তু আছেন মাত্র ৩ জন। মোট ১৯৯ জনের পরিবর্তে মাত্র ১০০ জন কর্মী দিয়ে চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। জনবল ঘাটতি রয়েছে ৯৯ জনের।
সার্জারি যন্ত্রপাতির ঘাটতি, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, পানি ও বিদ্যুৎ সংকট, নোংরা বাথরুমসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হাসপাতালটি। প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি অপারেশন থিয়েটার দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিন ৪০০-৫০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসলেও অধিকাংশকেই জেলা হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়।
বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই। যারা আছেন, তাদের অনেকেই নিয়মিত রোগী দেখেন না। অফিস সময়ে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখাকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় সাধারণ মানুষকে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যও প্রাইভেট ক্লিনিক বা শহরের হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।
অসুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে আসা ফারিবা আক্তার বলেন, সকাল ৮টায় এসেছি, বেলা সাড়ে ১১টা বাজলেও এখনো ডাক্তারের দেখা মেলেনি। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, আরও ৩০ জনের পরে দেখা হবে। এত দেরিতে কীভাবে চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব?
এক ভুক্তভোগী রোগীর স্বজন বলেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার আশায় এসেছিলাম। কিন্তু এখানে নেই সঠিক চিকিৎসক, নেই মানসম্মত খাবার, নেই পর্যাপ্ত ওষুধ। সব কিছুই সিন্ডিকেটের দখলে।
সেবা নিতে আসা রোগীরা নানা অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালে সব ধরনের সেবা থাকলেও ডাক্তার ও ল্যাব টেকনিশিয়ানরা তাদেরকে প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। দুই একটি ওষুধ ছাড়া সব ওষুধ বাহির থেকে কিনতে হচ্ছে। ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না বাথরুম। পুরুষ ও মহিলা রোগীদের একই বাথরুম ব্যবহার করতে হয়।
রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, অধিকাংশ বেড ভাঙা, ফ্যান ও লাইট অচল, ফলে রাতে অন্ধকারে ভূতুড়ে অবস্থা তৈরি হয়। কেবিনগুলো সবসময় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের দখলে থাকে। রোগীদের জন্য সরকারি খরচে সরবরাহ করা খাবার মানহীন। অনেকেই বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে খাবার আনেন। বিনা মূল্যের ওষুধও নামমাত্র সরবরাহ করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দালাল ও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে জিম্মি করে রেখেছে। ওষুধ ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় প্রতিবছর লাখ লাখ টাকার দুর্নীতি হয়। টেন্ডারে উল্লেখিত মানের জিনিস না দিয়ে নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। এমনকি স্টোরে কোটি টাকার সম্পদ থাকলেও নাইট গার্ড নেই, যে কারণে চুরির ঝুঁকি সব সময় বিরাজ করছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌফিক পারভেজ বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে একই ঠিকাদার দীর্ঘদিন ধরে খাবার সরবরাহ করছে। নি¤œমানের খাবার না দেওয়ার জন্য বহুবার নির্দেশ দেওয়া হলেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শার্শা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল সংকট চরমে। ৩১ শয্যার জনবল দিয়েই ৫০ শয্যার সেবা দিতে হচ্ছে। কেউ যদি রোগীদের অন্যত্র পাঠায়, সে বিষয়ে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

