ব্রজেন দাস, আবদুল মালেক ও মোশাররফ হোসেনের পর ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন বাংলাদেশের দুই সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর ও নাজমুল হক হিমেল। ৩৭ বছর পর ছয়জনের রিলে দলের হয়ে এই সাফল্য দেখান তারা। ইংলিশ চ্যানেল জয় করে দেশে ফিরেছেন কীর্তিমান এ দুই সাঁতারু। প্রথমবারের মতো আটলান্টিক মহাসাগরে সাঁতার কেটে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে গিয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের। এজন্য নানা বাধা আর চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি হতে হয়েছিল এই দুজনকে। সব কিছু অতিক্রম করে বিখ্যাত ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া সাঁতারুর স্বীকৃতি পেলেন তারা। দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের সাক্ষাৎকারে নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন সাঁতারে বীরত্ব দেখানো সাগর ও হিমেল। তাদের সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশটুকু তুলে দেওয়া হলো
*ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া সাফল্যের পেছনের গল্পটা যদি বলেন?
সাগর: আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেব, তা তো বললেই হয়ে যায় না। সে ক্ষেত্রে ২০১৫-২০১৬ সালের দিকে একটা পরিকল্পনা করেছিলাম। তবে সেই পরিকল্পনা কবে বাস্তবায়ন করতে পারব, তা আসলে জানা ছিল না। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকতে থাকতে ২০২৩ সালে আমরা স্লট পাই। এই স্লটে ২০২৫-এ সাঁতার কাটতে পারবÑ এই রকম আরকি। কিন্তু টিম দরকার ছিল আমার জন্য। একা তো আর সুইমিং করব না। একটা হলো রিলে করা যায়, আরেকটা হলো সোলো করা যায়। রিলে টিমটা বানাইতে একটু চাপ নেওয়া লাগছে। এখানে উপযুক্ত টিম ছাড়া অন্য যেকোনো একজনের ভুলে পুরো টিম ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বা পরিকল্পনাটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই একটা এক্সপার্ট টিম নিয়েই আসলে সাঁতার করা।
*সাফল্য পাওয়ার পেছনে আর কী কী বিষয় কাজ করেছে?
সাগর: এখানে অর্থনৈতিক ব্যাপার ছিল। যোগাযোগের ব্যাপার ছিল। ভিসা প্রসেস থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনারও ব্যাপার ছিল। ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। আর ফাইনাল যেটা, সেটা হলো আবহাওয়া। আমাদের আবহাওয়া আর ইংল্যান্ডের আবহাওয়া এক নয়। তা ছাড়া পানির টেম্পারেচার থেকে শুরু করে অন্য যেসব বিষয় থাকে, যেটা সুইমিংয়ে। সেগুলো বাদে অন্য অনেক কিছুই থাকে, যেগুলো নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ফাইনালি যখন ভিসা পেয়েছি, তখন আমরা ট্রেনিং করে গেছি। ঠান্ডা পানিতে, আইস বার্থ, রেগুলার সুইমিং এগুলো করার পাশাপাশি মানসিক ও শারীরিকভাবে আমরা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম যে যেভাবেই হোক আমরা সাঁতারটা শেষ করব।
*আটলান্টিক মহাসাগরে সাঁতরাতে গিয়ে কী ধরনের অভিজ্ঞতা হলো আপনার?
সাগর: আমরা রাতে কখনো সুইমিংপুলেও সাঁতার কাটিনি। পুকুরেও সাঁতার কাটিনি একদম অন্ধকারে। আমাদের সাঁতারটা শুরু হয়েছিল রাত ২টা ৪৩ মিনিটে। আমিই শুরু করেছিলাম ইংল্যান্ডের সাইড থেকে। তো আটলান্টিক মহাসাগরে ১৭ ডিগ্রি টেম্বারেচার, এত ঠান্ডা পানিতে আসলে খুবই ভয়াবহ অবস্থা। তার আগে সি সিকনেস তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমাদের। যেখান থেকে সাঁতার শুরু, সেখানে আমাদের সবকিছু ব্রিফ করা হয়েছিল। তার মধ্যে ২০-২৫ মিনিটের একটা দূরত্ব ছিল, যেটি বোর্ডের দূরত্ব। বোর্ডে করে যেতে হয়। তো ওখানে যাওয়ার সময় বমি শুরু করে দেই। যেটাকে সি সিকনেস বলে। নৌকা বা জাহাজ দোলার কারণে যে সিকনেসটা তৈরি হয়। এভাবে আমি বমি করে ফেলি। তখন সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে এটা। আমি ভাবি, আমি অসুস্থ। এই অসুস্থতা নিয়ে আমি কী সাঁতার কাটব, কীভাবে সম্ভব! তারপর বমি করতে করতে ফাইনালি দ্রুত প্রস্তুত হয়েছি এবং সাঁতার শুরু করেছি। সাঁতার শুরু করার পরও বমি করি। সাঁতার শেষ করার পরও বমি করি। এইভাবে চলতে চলতে একসময় ফ্রান্সে যাই।
*সবকিছু মিলে ইংলিশ চ্যানেলে সাঁতার কাটার পুরো ব্যাপারটাকে কী বলবেন?
সাগর: যে ঠান্ডা পানি, ঢেউ, ঢেউয়ের বিপরীতে সাঁতার কাটা, লবণাক্ত পানি, জেলি ফিশ, মাঝ সমুদ্রে জাহাজ আসা-যাওয়ার ঢেউ, ফেরি যাতায়াতÑ আসলে এসব মিলে রূপকথার গল্পের মতোই ব্যাপারটা। অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল, আমি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেব। পরিকল্পনাটা করি অনেক আগে থেকেই। সোলো করার ইচ্ছা ছিল। ফাইনালি রিলেতে করেছি। ইংল্যান্ড থেকে শুরু করেছি আমি। আর ফ্রান্সের গিয়ে স্পর্শ করা বা দাঁড়ানোÑ সেটাও আমার। সে ক্ষেত্রে আসলে সবকিছু মিলে এটা ছিল একটা কমপ্লিট প্যাকেজ। ব্যাপারটি স্বপ্নের থেকেও সুন্দর বলা যায়। যেহেতু বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা ৩৭ বছর পর। এটা একটা বিশাল ব্যারিয়ার ছিল যে, কেন এত দিন গ্যাপ থাকবে। এর মধ্যে কেন কেউই চেষ্টা করেনি, তাই এটা একটা ব্যাপার ছিল। সবকিছু মিলে আমি সার্থক, সাফল্য এসেছে। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতে পারে।
*নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে আপনার কী বার্তা থাকবে?
সাগর: এটা অনুপ্রাণিত করতে পারে পরবর্তী প্রজন্মকে। এই অনুপ্রেরণা নিয়ে যদি কেউ ভবিষ্যতে সুইমিংটা করতে চায়, তার আগে দৃঢ়তা থাকতে হবে যে, আমি এটা করব। এটা আমি করব, যেকোনো মূল্যে আমি করব। এখানে বাধা আসতে পারে অর্থনৈতিক, মানসিক, শারীরিক, ট্রেনিংসহ অনেক কিছু। প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে। তাহলেই সফলতা আসবে।
*এই দুঃসাহসিক সাফল্যের পেছনে কী কাজ করেছিল?
হিমেল: আমার বাবা আশির দশকের একজন সাঁতারু। আমার দুই ভাই, তারাও সাঁতারু। তাদের সন্তানও সাঁতারু। পারিবারিকভাবে আমরা যেহেতু সবাই সাঁতারু, আমাদের বড় ইচ্ছা থাকে কিছু করার। আমাদের কেউই অলিম্পিকে যায়নি। এটা আমার মনে আক্ষেপ ছিল। তাই পরিকল্পনা ছিল, বড় একটা ইভেন্টে অংশ নেব। ২০২২ সালে মাহফিজুর রহমান সাঁতারু বলেছিল এই রকম একটা পরিকল্পনার কথা। ও আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছে। পরে ধাপে ধাপে আমরা এগিয়েছি। যে সাফল্যে দেশের মুখ উজ্জ্বল করা যায়, সেটি অর্জন করতে কার না ভালো লাগে! ভবিষ্যতে যদি স্পনসর পাই, তাহলে আবার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছা আছে। আটলান্টিক মহাসাগরে সাঁতার কাটতে নামার আগে ইউটিউব, অনলাইনের মাধ্যমে রিচার্স করেছিলাম। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ঠান্ডা পানি, জেলি ফিশ আর সি সিকনেস (বোর্ড হেলেদুলে চলার কারণে মাথাব্যথা ও বমি বমি ভাব)। ওয়েবসাইটে দেখি, বেশির ভাগ মানুষ সি সিকনেসে ভোগে।
*মহাসাগরে সাঁতার কাটার অভিজ্ঞতা যদি বলেন?
হিমেল: আটলান্টিক মহাসাগরে ঢেউ আর সি সিকনেস আমাকে বেশি ভোগায়। এটি আমার সবচেয়ে বেশি মনে থাকবে। আর জেলি ফিশের ব্যাপারে বলবÑ আমি যখন সুইমিং করি, খুব একটা বেশি দেখিনি। যা দেখেছি কিংবা আমার আশপাশে ছিল, তাতে কিছুটা ভয় লেগেছিল। আমার কাছেই একটা ভাসছিল। একটা ঢেউ এসে দুজনকে এক দিকে নিয়ে যায়। জেলি ফিশ সাঁতার কাটতে পারে না। পানিতে ভেসে থাকে। আমার সংস্পর্শে থাকলে চামড়ার সঙ্গে লেগে যেত। ভয় লাগছিল যে, জেলি ফিশ যদি না আমার শরীরে পেঁচিয়ে থাকে। কারণ এ রকম হয়েই থাকে। জেলি ফিশের ওপর দিয়ে সুইমিং করবÑ এটা কখনো ভাবিনি। এটি খুবই রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা।
*সফল হওয়ার পর কেমন মনে হয়েছিল?
হিমেল: আমাদের লাস্ট ফিনিশিং ম্যান ছিল মাহফিজুর রহমান সাগর। যখন ও হাত তুলল, সে পানিতে নাই, ফিনিশিং লাইনে পানি স্পর্শহীন, তখন বোর্ড থেকে হুইসেল দিল যে সে ক্লিয়ার। আমাদের মধ্যে তখন যে কী উল্লাস, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
*ভবিষ্যতে আবার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছা আছে কি না?
হিমেল: আর্থিক দিক থেকে এটা খুবই ব্যয়বহুল। ৭ থেকে ৮ হাজার ডলারের মতো খরচ হয়। আসলে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটা অনেক টাকা। আমরা যেহেতু গ্রাম এলাকার মানুষ, আমাদের জন্য এই রকম একটি পরিকল্পনা নিতে গেলে অনেক চিন্তা করে নিতে হয়। আমি একবার নিছি। অনেক উপভোগ করেছি। ভবিষ্যতে যদি কোনো স্পনসর পাই, তাহলে আমি চাইব আরও একবার যেন যেতে পারি। কে না চায় এই ধরনের একটা লোভনীয় স্বীকৃতি!
আপনার মতামত লিখুন :