নেত্রকোনার কলমাকান্দা, বাংলাদেশের এক নিভৃত ভ্রমণপল্লি। যেখানে মিশে আছে মেঘ, পাহাড়, নদী আর ইতিহাসের অপরূপ স্নিগ্ধতা। যারা প্রকৃতি ভালোবাসেন, যাদের মনে পাহাড়ের নিস্তব্ধতা কিংবা নদীর নরম শব্দ রোমাঞ্চ জাগায়, তাদের জন্য কলমাকান্দা এক স্বপ্নের ঠিকানা। এই অঞ্চল যেন মেঘালয়ের সীমান্তঘেঁষা সবুজ কোনো নীলাভ অনুভব, যেখানকার আকাশে প্রতিদিনই নামে নতুন কোনো মেঘ, বৃষ্টি ছুঁয়ে যায় বারবার, আর বাতাসে থাকে পাহাড়ের ঘ্রাণ। নেত্রকোনা জেলার সবচেয়ে উত্তরে ভারতের সীমান্ত লাগোয়া থানার নাম কলমাকান্দা। এই উপজেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয়, দক্ষিণে বারহাট্টা উপজেলা ও নেত্রকোনা সদর উপজেলা, পূর্বে সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর উপজেলা, পশ্চিমে দুর্গাপুর উপজেলা। কলমাকান্দার নামকরণ নিয়ে আছে নানারকম জনশ্রুতি। লোকমুখে জানা যায়, অতীতের কোনো এক সময় পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা পানির সঙ্গে পলিমাটি এসে এ অঞ্চল ভরাট ভূমিতে রূপান্তরিত হয়। এ ভরাট ভূমির স্থানীয় নাম কান্দা। কান্দায় জন্মানো কলমি গাছ (জলজ উদ্ভিদ) মাটি আটকে ধরে এ ভরাট ভূমিতে আরও মাটি সঞ্চয় করতে সহায়তা করে। সে কারণেই প্রথমে স্থানটি কলমিকান্দা নামে পরিচিত হয় ও পরে মানুষের মুখের ভাষায় কলমাকান্দা নামে পরিণত হয়। আরেক জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, গারো পাহাড়ে উৎপন্ন প্রচুর কমলা এ স্থানে সমতলবাসী ও পাহাড়ি গারোদের মাঝে ক্রয়-বিক্রয় হতো। এ কারণে এ কান্দা অঞ্চলটি কমলাকান্দা নামে পরিচিতি লাভ করে। কালের পরিক্রমায় কমলাকান্দা অঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে থাকলে তারা কমলাকান্দাকে কলমাকান্দা নামে আখ্যায়িত করে। এখন পর্যন্ত অনেকেই কলমাকান্দাকে কমলাকান্দা নামেই ডাকে। তবে শুধু নামেই বিস্ময় নয়, এখানেকার প্রকৃতিও মুহূর্তে মুহূর্তে দেখায় নানা বিস্মময়ের খেলা। কলমাকান্দার রংছাতি ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রাম সবুজের গায়ে আঁকা এক জলরঙের ছবি। চন্দ্রডিঙ্গা পাহাড় এখানে উঠে দাঁড়িয়েছে নীরবে, আর তার পাদদেশে নামা ছোট্ট ঝরনা যেন পাহাড়ের অশ্রুবিন্দু হয়ে নেমে আসে। এখানে বসবাসকারী গারো ও হাজং জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা আর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আপনাকে শেখাবে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা মানুষের সত্যিকারের সরলতা। চন্দ্রডিঙ্গার পথ ধরে যেতে যেতে দুচোখ ভরে যায় ধানখেত, দূর পাহাড় আর মাঝেমধ্যে উঁকি দেওয়া মেঘের শরীর। এমনকি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হবে, আপনি কোনো কবিতার ভেতরে হাঁটছেন, যার প্রতিটি পঙক্তিতে লেখা পাখির ডাক, ঝিরিপথের শব্দ আর নিসর্গের নৈঃশব্দ্য। এরপর আসুন পাতলার বনে। পাতলা নামের মতোই তার ছায়া ঘন নয়, তবে রহস্যময়। সীমান্তঘেঁষা এই বনকে ঘিরে যে নির্জনতা, তা হাঁটতে হাঁটতে চুপিসারে আপনাকে ছুঁয়ে যাবে। এখানেই বয়ে চলে গণেশ্বরী নদী। সেই জলধারা যেটি পাহাড় থেকে নেমে এসে বাংলাদেশকে প্রাণ দেয়। নদীর ধারে বসে থাকলে হঠাৎ মনে হয়, সময়ও বুঝি কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গেছে। গণেশ্বরীর পাশে রাবার ড্যাম। তার একপাশে গর্জনধ্বনি, আরেক পাশে প্রকৃতির শান্ত গৃহসজ্জা। আর মোমিনের টিলা? সেখান থেকে চারপাশের যে দৃশ্য দেখা যায়, তা কোনো চিত্রকর কল্পনাও করতে পারবেন না। টিলার চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন তাকাবেন, দেখবেন, পাহাড়, বন, নদী আর মানুষের ঘরবাড়ি মিলে গড়ে উঠেছে এক জীবন্ত পটচিত্র। কিন্তু কলমাকান্দা শুধু প্রকৃতির জন্য নয়, এখানে লুকিয়ে আছে রক্তের ইতিহাসও। ফুলবাড়ি গ্রামের সাত শহিদের মাজারে গেলে আপনি আর শুধু দর্শক থাকবেন না, আপনি হয়ে উঠবেন স্মৃতির সঙ্গী। ১৯৭১ সালে, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাদের নাম আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এই মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে মন ছুঁয়ে যায় এক অজানা শূন্যতায়। মনে হয়, এখানেই হয়তো এখনো রয়ে গেছে সেই প্রতিরোধের প্রতিধ্বনি, সেই সাহসের আলো। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও দুঃখ একসঙ্গে মিশে আছে এই মাটিতে। তাই কলমাকান্দা ঘোরা মানে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা নয় এ এক হৃদয়ের সফর, যেখানে আপনি নিজের অতীত, শিকড় ও পরিচয়ের সঙ্গে মুখোমুখি হবেন। প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে, পাহাড়ের গায়ে হেঁটে, নদীর ধারে বসে কিংবা শহিদদের মাজারের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বুঝবেন এই দেশটা কেবল মানচিত্রের কোনো রেখা নয়, এ দেশ অনুভবের, ভালোবাসার, আত্মত্যাগের। কলমাকান্দা কোনো বিলাসবহুল পর্যটনকেন্দ্র নয়, কিন্তু এ এমন এক জায়গা, যেখানে গেলে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না। বরং মনে হয়, জীবনের জটিলতা ফেলে এখানেই থেকে যাই, পাহাড়ের নিঃশব্দতা আর নদীর চিরন্তন ধারা সঙ্গে নিয়ে। বর্ষাকালে কলমাকান্দার প্রকৃতি আরও মোহময় হয়ে ওঠে প্রতিদিনই মেঘ আসে, ঝরে পড়ে বৃষ্টি, পাহাড় থেকে নেমে আসে স্রোতস্বিনী জলধারা। এই জল, এই মাটি, এই ইতিহাস জানতে ঘুরে আসতে পারেন এই মোহনীয় গন্তব্যে।
যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে কলমাকান্দা যাওয়ার জন্য মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি নেত্রকোনাগামী বাসে উঠতে পারেন। বিআরটিসি, এনা, হানিফের মতো পরিবহন নিয়মিত বাস চালায়। ময়মনসিংহ হয়ে নেত্রকোনা; তারপর সেখান থেকে সিএনজি, অটো বা মোটরসাইকেলে পৌঁছাতে পারবেন দিনে ৮০০-১২০০ টাকায় বাইক ভাড়া পাওয়া যায়। রাস্তা কিছুটা কাঁচা ও উঁচুনিচু। বর্ষায় যেতে চাইলে অবশ্যই অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করুন। সঙ্গে রাখুন হালকা ব্যাগ, পর্যাপ্ত খাবার ও পানি এবং অবশ্যই জায়গাগুলোর সৌন্দর্য অবলোকন করার মতো স্থির মন-মানসিকতা।