বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের বুকে ভেসে থাকা ছোট্ট এক স্বপ্নরাজ্য সেন্টমার্টিন দ্বীপ। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ, আর এই কারণেই এর সৌন্দর্য আলাদা, ভিন্ন ও মায়াবী। নীল জলরাশির অবিরাম ঢেউ, আকাশের অসীম নীলিমা, নারিকেল গাছের সারি, আর বালুকাবেলার নিস্তব্ধতা মিলিয়ে সেন্টমার্টিন যেন এক অপার শান্তির ঠিকানা। প্রকৃতির হাতে গড়া এক মহাকাব্যিক সৃষ্টি এই দ্বীপ; যেখানে সমুদ্র, আকাশ আর ভ‚মি একাকার হয়ে গেছে এক বিস্ময়কর সাদৃশ্যে। দ্বীপটির আয়তন প্রায় ১৭ বর্গকিলোমিটার, কিন্তু এই ছোট্ট আয়তনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক মহাবিশ্বের সৌন্দর্য। এখানকার সকাল শুরু হয় সোনালি আলোয় রাঙা সূর্যোদয়ে, আর দিনশেষে সূর্যাস্তের কমলা আভা মিশে যায় সাগরের বুকে। সেন্টমার্টিনের বালু এতই সাদা আর কোমল যে, খালি পায়ে হেঁটে চললে মনে হয় তুলোর ওপর দিয়ে হাঁটছি। জল এত স্বচ্ছ যে নিচে থাকা প্রবাল পাথর আর ছোট মাছগুলোও স্পষ্ট দেখা যায়। ঢেউয়ের শব্দে মিশে থাকে বাতাসে এক অপার্থিব প্রশান্তি, যা শহুরে জীবনের কোলাহল থেকে মুক্তি খুঁজে পাওয়া মনকে গভীর শান্তিতে ভরে দেয়। প্রবাল দ্বীপ হিসেবে সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সমুদ্রের তলদেশে এখানে রয়েছে নানা রঙের প্রবাল ও শৈবাল, যা জোয়ারের সময় ঝলমলে রূপ নেয়। দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে ‘ছেঁড়া দ্বীপ’ নামে আরেকটি অংশ, যা জোয়ারে মূল দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, আবার ভাটায় সংযুক্ত হয়। এই প্রাকৃতিক পরিবর্তন পর্যটকদের কাছে এক অনন্য অভিজ্ঞতা এনে দেয় এবং একই দ্বীপ দিনে দুই রূপে রূপান্তরিত হয়। দ্বীপের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো নারিকেল গাছের প্রাচুর্য। চারদিকে দোল খাওয়া সবুজ পাতার সারি, যার ছায়ায় বিশ্রাম নিতে নিতে দূরে দেখা যায় আকাশের সীমানায় মিলিয়ে যাওয়া নীল সমুদ্র। এই নারিকেল গাছের আধিক্যের কারণেই স্থানীয়রা দ্বীপটিকে ভালোবেসে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ নামে ডাকেন। এখানে উৎপন্ন নারিকেল দেশের অন্যতম মিষ্টি ও সুস্বাদু হিসেবে পরিচিত। সেন্টমার্টিনের মানুষ সংখ্যায় খুব বেশি নয়। দ্বীপের বাসিন্দারা মূলত জেলে, যারা প্রতিদিন সমুদ্রে মাছ ধরতে যান। তাদের জীবনযাত্রা শান্ত, সহজ আর প্রকৃতিনির্ভর। তাই দ্বীপের পরিবেশে রয়েছে এক নির্জন অথচ নির্মল প্রশান্তি। সকালে ভাটার সময় দেখা যায় সমুদ্রের তলদেশে হাঁটতে থাকা জেলেরা, আর সন্ধ্যায় নারিকেল গাছের ফাঁক দিয়ে শোনা যায় ঢেউয়ের মৃদু গর্জন। রাতের আকাশে যখন অসংখ্য তারা জ্বলে ওঠে, তখন সেন্টমার্টিন হয়ে ওঠে এক স্বপ্নলোক, যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো নক্ষত্রপুরী। দ্বীপটি কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই নয়, পরিবেশবিদদের কাছেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রয়েছে প্রবাল প্রাচীর, সামুদ্রিক শৈবাল, নানা প্রজাতির মাছ, কচ্ছপ ও সামুদ্রিক পাখির বসবাস। বিশেষ করে বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ ‘লেপিডোচেলিস অলিভাসিয়া’ প্রতি বছর এখানে ডিম পাড়তে আসে। এই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকার ও স্থানীয় জনগণ একসঙ্গে কাজ করছে, যাতে প্রকৃতির এই অপার সৃষ্টিকে আগামীর প্রজন্মের জন্য টিকিয়ে রাখা যায়। সেন্টমার্টিনে সময় যেন ধীরে চলে। সকালে সূর্যের আলোয় জেগে ওঠা সৈকত, দুপুরের ঢেউয়ের গর্জন আর সন্ধ্যার নিস্তব্ধতায় মিশে থাকা তারাভরা আকাশ মিলিয়ে এটি এমন এক জায়গা, যেখানে এসে মানুষ নিজেকে নতুন করে খুঁজে পায়। যারা ব্যস্ত শহুরে জীবন থেকে কিছুটা নিঃশব্দতা, প্রকৃতির সান্নিধ্য আর নীল সাগরের প্রশান্তি খুঁজছেন তাদের জন্য সেন্টমার্টিন হলো এক অব্যর্থ গন্তব্য।
যেভাবে যাবেন
সেন্টমার্টিনে পৌঁছাতে হলে প্রথমেই যেতে হবে কক্সবাজার জেলার টেকনাফে। দেশের প্রায় সব জেলা থেকেই কক্সবাজারে সরাসরি বাসযোগে যাওয়া যায়। ঢাকার কল্যাণপুর, শ্যামলী, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদসহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন কক্সবাজার ও টেকনাফের উদ্দেশ্যে এসি ও নন-এসি বাস ছাড়ে। যাত্রাপথে সময় লাগে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা, আর প্রতি সিটের ভাড়া ৯০০-২০০০ টাকার মধ্যে। যারা সরাসরি টেকনাফ যেতে চান, তাদের জন্যও বাস সার্ভিস রয়েছে। টেকনাফ থেকে জাহাজে করেই যেতে হয় সেন্টমার্টিনে। ভোরবেলা বা সকাল ৯টার দিকে জাহাজগুলো ছেড়ে যায় এবং প্রায় দুই ঘণ্টা পর পৌঁছায় দ্বীপে। এই যাত্রাপথের প্রতিটি মুহূর্ত রোমাঞ্চে ভরা, নীল সমুদ্রের বুকচিরে চলা জাহাজ, আকাশে উড়ন্ত সীগাল, আর দূর থেকে দেখা যায় ছোট্ট দ্বীপটির সবুজ ছায়া। জাহাজ ভাড়া জনপ্রতি যাওয়া-আসা মিলিয়ে সাধারণত ৬০০-৮০০ টাকা (নন-এসি) এবং ১০০০-১৬০০ টাকা (এসি)। ( এ বছর পরিবর্তন হতে পারে) যারা একটু বিলাসীভাবে ভ্রমণ করতে চান, তারা এসি জাহাজ বা ক্রুজ সার্ভিস বেছে নিতে পারেন। সেন্টমার্টিনে পৌঁছে প্রথমেই হোটেল ঠিক করে নিতে হয়। বেশিরভাগ জাহাজ দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে পৌঁছে যায়। তাই প্রথম দিন বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বিচে ঘুরে বেড়ানোই সবচেয়ে ভালো পরিকল্পনা। সূর্যাস্তের সময় নীল জলের ওপরে যখন কমলা আলো ঝরে, তখন পুরো দ্বীপ যেন জাদুকরী রূপ ধারণ করে।
থাকা-খাওয়া
সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের থাকার জন্য রয়েছে উন্নতমানের হোটেল, কটেজ ও রিসোর্ট। দ্বীপের প্রায় প্রতিটি কোণেই থাকার ব্যবস্থা পাওয়া যায়। সামুদ্রিক বাতাসে ভরা সমুদ্রদৃশ্যমান কক্ষ থেকে শুরু করে সাধারণ বাজেটের কটেজ পর্যন্ত। সাধারণ মানের হোটেলগুলোর কক্ষভাড়া ৮০০-১২০০ টাকা, আর ডাবল বেড বা সমুদ্র-দৃশ্যমান রুমের ভাড়া ১২০০ ২০০০ টাকার মধ্যে (পরিবর্তন হতে পারে)। খাওয়ার ক্ষেত্রে সেন্টমার্টিনে মূল আকর্ষণ হলো তাজা সামুদ্রিক খাবার। এখানে প্রতিদিনই পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, যেমন রূপচাঁদা, চিংড়ি, কোরাল, লইট্টা ইত্যাদি। দ্বীপের রেস্টুরেন্টগুলোতে দুপুরে ভাত, ডাল, ভাজি ও সামুদ্রিক মাছের ঝোল খেতে পারেন। সন্ধ্যায় প্রায় সব হোটেলেই আয়োজন করা হয় বার-বি-কিউর। আগুনের আলো, ঢেউয়ের শব্দ আর সুগন্ধি মসলায় ভাজা মাছ। এই অভিজ্ঞতা যে একবার পেয়েছে, সে সহজে ভুলতে পারে না।
সরকারি নির্দেশনা
নভেম্বর থেকে সেন্টমার্টিনে ভ্রমণ চালু হলেও প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কঠোর নির্দেশনা জারি করেছে সরকার।
যাতায়াত ও টিকিট:
১. শুধু বিআইডবিøউটিএ ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত নৌযান চলাচল করবে।
২. টিকিট কিনতে হবে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের অনুমোদিত অনলাইন পোর্টাল থেকে।
৩. প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড বাধ্যতামূলক (কিউআর কোড ছাড়া টিকিট অবৈধ)।
ভ্রমণ সময়সূচি:
১. নভেম্বর: শুধু দিনের বেলা ভ্রমণ, রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ।
২. ডিসেম্বর-জানুয়ারি: রাত্রিযাপন করা যাবে।
৩. ফেব্রুয়ারি: পর্যটক যাতায়াত সম্পূর্ণ বন্ধ।
৪. প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২,০০০ পর্যটক প্রবেশের অনুমতি।
নিষেধাজ্ঞা:
১. সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি, বারবিকিউ, মোটরচালিত যান চলাচল নিষিদ্ধ।
২. কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ/বিক্রি, প্রবাল, পাখি, কাছিম ইত্যাদি ক্ষতি করা নিষিদ্ধ।
৩. পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক (চিপস প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, মিনিপ্যাক ইত্যাদি) বহন নিরুৎসাহিত।
পরামর্শ:
নিজস্ব পানির ফ্লাক্স সঙ্গে রাখুন, পরিবেশবান্ধব আচরণ করুন।

