ময়মনসিংহে নবগঠিত উত্তর জেলা ছাত্রদল কমিটির সভাপতি নুরুজ্জামান সোহেলের ছাত্রত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একই কমিটির ৬ ছাত্রদল নেতা। তাদের দাবি, সভাপতি নন-মেট্রিক ও বর্তমানে তিনি ছাত্র না।
একই সঙ্গে সভাপতি বিরুদ্ধে গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে নৌকার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়া একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে চলছে সমালোচনা।
বলা হচ্ছে, কমিটির সভাপতি নুরুজ্জামান সোহেল আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনে প্রচারণায় ছিলেন। এ ছাড়া তার পড়ালেখাও যতসামান্য। ফলে তাকে পদ থেকে সরিয়ে দলের জন্য নিবেদনপ্রাণ উপযুক্ত নেতাকে সভাপতি পদে দ্বায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
বৃহস্পতিবার (৫ জুন) লিখিত অভিযোগটি হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, নবগঠিত ১১ সদস্যের উত্তর জেলা ছাত্রদল কমিটির মধ্যে ৬ জনই বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা গত ১৮ মে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন।
অভিযোগের অনুলিপি বিএনপির নির্বাহী কমিটির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদল ময়মনসিংহ বিভাগীয় টিমের (উত্তর ছাত্রদল) কাছে পাঠানো হয়েছে।
এতে স্বাক্ষর করেন, নবগঠিত উত্তর জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি নাইমুর আরেফিন পাপন, মাসুদুর রহমান মাসুদ, মাসুদ আলম (মাসুদুল আলম মাসুদ), নাদিম সারোয়ার টিটু, যুগ্ম সম্পাদক সাইফুজ্জামান সরকার শাওন ও সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল আলম রুবেল।
এসব নেতারা দাবি করেন, যারা জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছে, সংগ্রাম করেছে, তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। যাকে সভাপতি করা হয়েছে, তিনি নন-মেট্রিক। এ ছাড়া তিনি নৌকার পক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। যার ভিডিও ফুটেজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
তবে নবগঠিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম সুজা উদ্দিনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থীর সঙ্গে প্রচারণার অভিযোগ তুলতে না পারাসহ শিক্ষাগত যোগ্যতায়ও ঘাটতির অভিযোগ না তুলতে পারলেও তিনি চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি সাংগঠনিক নিষ্ক্রিয়তার জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশপ্রাপ্ত (শোকজ) পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
সভাপতি হিসেবে দ্বায়িত্ব পাওয়া নুরুজ্জামান সোহেলের বিষয়ে বলা হয়, রাষ্ট্রীয়, অবকাঠামো মেরামতে বিএনপির ৩১ দফার মধ্যে ২৪ নম্বর দফায় উল্লেখ রয়েছে, বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করে নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সভাপতির কোন ছাত্রত্ব নেই। ইতোমধ্যে জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, বিভিন্ন মহল প্রচারণা চালাচ্ছে যে, নন-মেট্রিক ও অযোগ্য ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। যা আমার দলের জন্য খুবই লজ্জাজনক।
এদিকে, আওয়ামী লীগের প্রচারণায় নুরুজ্জামান সোহেলের অংশগ্রহণের পুরাতন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সোমবার (২ জুন) ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে দেখা যায়, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত অনেকের সাথে একটি কক্ষে নৌকার প্রার্থীর প্রচারণায় ছিল নুরুজ্জামান সোহেল।
কক্ষে আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের সঙ্গে বসে আছেন নুরুজ্জামান সোহেল। উপরে দেয়ালে টানানো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। মোবাইল দিয়ে একজন সোহেলকে ভিডিও করার সময়, পাশ থেকে আরেকজন বলতে থাকেন, ‘এখানে সোহেল্লা আসছে, এটাই সর্বনাশ।’ এ সময় একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘ছবি তুলেন কেন?’ এমতাবস্থায় ভিডিও করা বন্ধ করা হয়।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এইচ.এম ইমন সরকার নামের একজন পোস্টের কমেন্টে লিখেছেন, ছাত্রদল চলছে আওয়ামী লীগের দোষরের কাধে দায়িত্ব নিয়ে। ২৮ অক্টোবর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত যেখানে সকল জাতীয়তাবাদের সৈনিকেরা মানবেতর জীবন-যাপন করছিল, সেখানে আওয়ামী নির্বাচনে প্রকাশ্যে নৌকা প্রচারণায় ব্যস্ত নুরুজ্জামান সোহেলকে বানানো হয় উত্তর জেলা ছাত্রদলের সভাপতি। যা ছাত্রদলের জন্য লজ্জাজনক। আমরা অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি।
তাহসিন আহমেদ সোহেল নামের আরেকজন বলেন, আওয়ামী দালাল ছাত্রদলের জেলা ইউনিটের সভাপতি। ছাত্রদল কলঙ্কিত। অবিলম্বে বহিষ্কার চাই। কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হোক।
নবগঠিত উত্তর জেলা ছাত্রদল কমিটির একজন নেতা বলেন, নুরুজ্জামান সোহেল গৌরীপুরে অবস্থিত আর.কে উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনবার এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েও পাস করতে পারেননি। এ ছাড়া তিনি আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীর প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেছে। ছাত্রদলের প্রতি ভালোবাসা থাকলে কখনোই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া সম্ভব হতো না। তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
একই কমিটির সহসভাপতি মাসুদুর রহমান মাসুদ বলেন, ত্যাগী নেতাদের উপযুক্ত পদ থেকে বঞ্চিত করে আমাদের নবগঠিত কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এই কমিটি বিলুপ্ত করার দাবি জানাচ্ছি।
একই কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল আলম রুবেল বলেন, নুরুজ্জামান সোহেলকে কমিটির সভাপতি পেয়ে অনেক নেতা-কর্মী ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কারণ, তার পড়ালেখা যতসামান্য থাকাসহ তিনি নৌকার প্রার্থীর প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ময়মনসিংহ উত্তর জেলা ছাত্রদলের কমিটির সাধারণত সম্পাদক এ কে এম সুজা উদ্দিন বলেন, আমার বাসা ফুলপুর। এই উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক ছিলাম। একবার আমাকে শোকজ করলেও স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে জবাব দিয়েছিলাম। বিগত সময়ে অনেক মিথ্যা মামলায় আসামি হয়েছি। দল অনেক যাচাই-বাছাই করে উত্তর জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পদে দ্বায়িত্ব দিয়েছে। দলের জন্য বিগত সময়ে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছি, ভবিষ্যতেও করে যাব।
অভিযোগ ওঠার বিষয়ে জানতে চাইলে একই কমিটির সভাপতি নুরুজ্জামান সোহেল বলেন, যে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে এটি মিথ্যা। এটিতে সুপার এডিট হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা চালানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে আমার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা হয়েছে।
পড়ালেখা নিয়ে বিতর্ক হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি নন-মেট্রিক না। তবে বিগত সময়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা থাকাসহ নানা কারণে খুব বেশি পড়ালেখা করা হয়নি। তবে কোন পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি, তা বলতে চাই না।
উত্তর জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি নিহাদ সালমান দুনন বলেন, কমিটি দেওয়ার আগে শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ অনেককিছু যাচাই-বাছাই করা হয়। নবগঠিত কমিটির সভাপতি নুরুজ্জামান সোহেলের পড়ালেখা নিয়ে ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের মধ্যেই কিছুটা প্রশ্ন উঠেছে। তবে এ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো মন্তব্য নেই। কারণ, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষর করে ইতোমধ্যে কমিটির অনুমোদন দিয়েছেন।
একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক রায়হান শরীফ হলুদ বলেন, ছাত্রদলের নেতৃত্বে আসতে হলে নির্ধারিত পরিমাণ যোগ্যতা থাকতে হয়। দলের বিরুদ্ধে কোন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা যাবে না। এবার কমিটির হওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল আবেদনে কি কি যোগ্যতার কথা উল্লেখ করেছে আমার জানা নেই। ফলে এ নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আমার মন্তব্য নেই।
কমিটির সভাপতি নুরুজ্জামান সোহেলের গ্রামের বাড়ি জেলার গৌরীপুর উপজেলায়। তিনি গৌরীপুর উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ও ময়মনসিংহ উত্তর জেলা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বলে জানিয়েছেন গৌরীপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আহম্মদ তায়েবুর রহমান হিরন।
তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নুরুজ্জামান সোহেলের বিরুদ্ধে যে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে এই ভিডিও সত্য। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছিলেন। একটি বাসায় বসে নৌকার প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেছিল সোহেল। এটি সোহেল অস্বীকার করতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, ২০০২ কিংবা ২০০৩ সালে সোহেল গৌরীপুরের আর.কে উচ্চ বিদ্যালয় স্কুল থেকে এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছিল। তখন পাস করতে পারেনি সোহেল। কয়েকবার পরীক্ষা দিয়েও অকৃতকার্য হয়েছে কিনা এই মুহুর্তে মনে নেই। তবে সোহেল এস.এস.সি পাস করতে না পেরে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছিল।
পরে জানতে পেরেছি, ২০১২ কিংবা ২০১৩ সালে ময়মনসিংহে উন্মুক্ত, টেকনিক্যাল অথবা মাদ্রাসা থেকে এস.এস.সি পাস করেছে। এরপর কলেজে ভর্তি হলেও এইচ.এস.সি পাস করেছে কিনা, আমার জানা নেই।
গত ১৫ মে সন্ধ্যায় ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি মো. রাকিবুল ইসলাম রাকিব তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে জেলা দক্ষিণ, উত্তর, মহানগর, আনন্দ মোহন কলেজ ও কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের আংশিক কমিটির তালিকা প্রকাশ করেন। দলীয় প্যাডে সংগঠনের সভাপতি মো. রাকিবুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির স্বাক্ষর করেন।
উত্তর জেলা ছাত্রদলের ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে নূরুজ্জামান সোহেল সভাপতি ও এ কে এম সুজা উদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এ ছাড়া কমিটির অন্যরা হলেন- সিনিয়র সহসভাপতি নাইমুর আরেফিন পাপন, সহসভাপতি মাসুদুর রহমান মাসুদ, মাসুদ আলম (মাসুদুল আলম মাসুদ), নাদিম সারোয়ার টিটু, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মনোয়ার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুজ্জামান সরকার শাওন, রাসেল আহম্মেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল আলম রুবেল ও দপ্তর সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন তালুকদার।
আপনার মতামত লিখুন :